কিন্তু জাজনগররাজের বিদায়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তুগরল তুগান খান ও তমুর খানের মধ্যে বিবাদ বাধিল এবং বিবাদ যুদ্ধে পরিণত হইল। সারাদিন যুদ্ধ চলিবার পর অবশেষে সন্ধ্যায় কয়েক ব্যক্তি মধ্যস্থ হইয়া যুদ্ধ বন্ধ করিলেন। যুদ্ধের শেষে তুগান খান নিজের আবাসে ফিরিয়া গেলেন। তাঁহার আবাস ছিল নগরের প্রধান দ্বারের সামনে এবং সেখানে তিনি সেদিন একাই ছিলেন। তমুর খান এই সুযোগে বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া তুগান খানের আবাস আক্রমণ করিলেন। তখন তুগান খান পলাইতে বাধ্য হইলেন। অতঃপর তিনি মীনহাজ-ই-সিরাজকে তমুর খানের কাছে পাঠাইলেন এবং মীনহাজের দৌত্যের ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হইল। সন্ধির শর্ত অনুসারে তমুর খান লখনৌতির অধিকারপ্রাপ্ত হইলেন এবং তুগান খান তাঁহার অনুচরবর্গ, অর্থভাণ্ডার এবং হাতিগুলি লইয়া দিল্লিতে গমন করিলেন। দিল্লির দুর্বল সুলতান আলাউদ্দীন মসূদ শাহ তুগান খানের উপর তমুর খানের এই অত্যাচারের কোনই প্রতিবিধান করিতে পারিলেন না। তুগান খান অতঃপর আউধের শাসনভার প্রাপ্ত হইলেন।
৯
কমরুদ্দীন তমুর খান-ই-কিরান ও জলালুদ্দীন মসূদ জানী
তমুর খান দিল্লির সুলতানের কর্তৃত্ব অস্বীকারপূর্বক দুই বৎসর লখনৌতি শাসন করিয়া পরলোকগমন করিলেন। ঘটনাচক্রে তিনি ও তুগরল তুগান খান একই রাত্রিতে (৯ মার্চ, ১২৪৭ খ্রী) শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁহার পর আলাউদ্দীন জানীর পুত্র জালালুউদ্দীন মসূদ জানী বিহার ও লখনৌতির শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হন। ইনি “মালিক-উশ-শর্ক” ও “শাহ্” উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন। প্রায় চারি বৎসর তিনি এ দুইটি প্রদেশ শাসন করিয়াছিলেন।
১০
ইখতিয়ারুদ্দীন য়ুজবক তুগরল খান (মুগীসুদ্দীন য়ুজবক শাহ)
জালালুদ্দীন মসূদ জানীর পরে যিনি লখনৌতির শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইলেন, তাঁহার নাম মালিক ইখতিয়ারুদ্দীন য়ুজবক তুগরল খান। ইনি প্রথমে আউধের শাসনকর্ত্তা এবং পরে লখনৌতির শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত হন। ইহার পূর্বে ইনি দুইবার দিল্লির তল্কালীন সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়াছিলেন, কিন্তু দুইবারই উজীর উলুগ খান বলবনের হস্তক্ষেপের ফলে ইনি সুলতানের মার্জনা লাভ করেন। ইঁহার শাসনকালে জাজনগরের সহিত লখনৌতির আবার যুদ্ধ বাধিয়াছিল। তিনবার যুদ্ধ হয়, প্রথম দুইবার জাজনগরের সৈন্যবাহিনী পরাজিত হয়, কিন্তু তৃতীয়বার তাহারাই য়ুজবক তুগরল খানের বাহিনীকে পরাজিত করে এবং য়ুজবকের একটি বহুমূল্য শ্বেতহস্তীকে জাজনগরের সৈন্যেরা লইয়া যায়। ইহার পরের বৎসর য়ুজবক উমর্দন রাজ্য [*এই রাজ্যের অবস্থান সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে] আক্রমণ করেন। অলক্ষিতভাবে অগ্রসর হইয়া তিনি ঐ রাজ্যের রাজধানীতে উপস্থিত হইলেন; তখন সেখানকার রাজা রাজধানী ছাড়িয়া পলায়ন করিলেন এবং তাঁহার অর্থ, হস্তী, পরিবার, অনুচরবর্গ–সমস্তই য়ুজবকের দখলে আসিল।
উমর্দন রাজ্য জয় করিবার পর য়ুজবক খুবই গর্বিত হইয়া উঠিলেন এবং আউধের রাজধানী অধিকার করিলেন। ইহার পর তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া সুলতান মুগীসুদ্দীন নাম গ্রহণ করিলেন। কিন্তু আউধে এক পক্ষ কাল অবস্থান করিবার পর তিনি যখন শুনিলেন যে তাঁহার বিরুদ্ধে প্রেরিত সম্রাটের সৈন্যবাহিনী অদূরে আসিয়া পড়িয়াছে, তখন তিনি নৌকাযোগে লখনৌতিতে পলাইয়া আসিলেন। য়ুজবক স্বাধীনতা ঘোষণা করায় ভারতের হিন্দু-মুসলমান সকলেই তাঁহার বিরূপ সমালোচনা করিতে লাগিলেন।
লখনৌতিতে পৌঁছিবার পর য়ুজবক কামরূপ রাজ্য আক্রমণ করিলেন। কামরূপরাজের সৈন্যবল বেশি ছিল না বলিয়া তিনি প্রথমে যুদ্ধ না করিয়া পিছু হটিয়া গেলেন। যুজবক তখন কামরূপের প্রধান নগর জয় করিয়া প্রচুর ধনরত্ন হস্ত গত করিলেন। কামরূপরাজ য়ুজবকের কাছে সন্ধির প্রস্তাব করিয়া দূত পাঠাইলেন। তিনি য়ুজবকের সামন্ত হিসাবে কামরূপ শাসন করিতে এবং তাহাকে প্রতি বৎসর হস্তী ও স্বর্ণ পাঠাইতে স্বীকৃত হইয়াছিলেন। য়ুজবক এই প্রস্তাবে সম্মত হন নাই। কিন্তু যুবক একটা ভুল করিয়াছিলেন। কামরূপের শস্যসম্পদ খুব বেশি ছিল বলিয়া য়ুজবক নিজের বাহিনীর আহারের জন্য শস্য সঞ্চয় করিয়া রাখার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। কামরূপের রাজা ইহার সুযোগ লইয়া তাঁহার প্রজাদের দিয়া সমস্ত শস্য কিনিয়া লওয়াইলেন এবং তাঁহার পর তাহাদের দিয়া সমস্ত পয়ঃপ্রণালীর মুখ খুলিয়া দেওয়াইলেন। ইহার ফলে য়ুজবকের অধিকৃত সমস্ত ভূমি জলমগ্ন হইয়া পড়িল এবং তাঁহার খাদ্যভাণ্ডার শূন্য হইয়া পড়িল। তখন তিনি লখনৌতিতে ফিরিবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু ফিরিবার পথও জলে ডুবিয়া গিয়াছিল। সুতরাং য়ুজবকের বাহিনী অগ্রসর হইতে পারিল না। ইহা ব্যতীত অল্প সময়ের মধ্যেই তাহাদের সম্মুখ ও পশ্চাৎ হইতে কামরূপরাজের বাহিনী আসিয়া ঘিরিয়া ধরিল। তখন পর্বতমালাবেষ্টিত একটি সংকীর্ণ স্থানে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে য়ুজবক পরাজিত হইয়া বন্দী হইলেন এবং বন্দীদশাতেই তিনি পরলোকগমন করিলেন।
মুগীসুদ্দীন য়ুজবক শাহের সমস্ত মুদ্রায় লেখা আছে যে এগুলি “নদীয়া ও অর্জ বদন (?)-এর ভূমি-রাজস্ব হইতে প্রস্তুত হইয়াছিল। কোন কোন ঐতিহাসিক ভ্রমবশত এগুলিকে নদীয়া ও “অৰ্জ বদন” বিজয়ের স্মারক-মুদ্রা বলিয়া মনে করিয়াছেন। কিন্তু নদীয়া বা নবদ্বীপ য়ুজবকের বহু পূর্বে বখতিয়ার খিলজী জয়–করিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, যুজবকের এই মুদ্রাগুলি হইতে এ কথা বুঝায় না যে য়ুজবকের রাজত্বকালেই নদীয়া ও অর্জ বদন (?) প্রথম বিজিত হইয়াছিল। ‘অর্জ বদন’-কে কেহ ‘বর্ধনকোটে’র, কেহ ‘বর্ধমানের, কেহ ‘উমদনে’র বিকৃত রূপ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন।