অর্থাৎ, ভারতবর্ষে আজো লোকায়তিক আর কাপালিকদের প্রভাব খুব প্রবল। আজো এমন অনেক সম্প্রদায় টেকে রয়েছে যার অনুগামীরা মনে করে দেহই হলো একমাত্র সত্য; তাদের ধর্মে স্ত্রী-পুরুষের মিলনই একমাত্র অনুষ্ঠান এবং তাদের মতে সিদ্ধি নির্ভর করছে এই মিলনের দীর্ঘস্থায়িত্বের উপর। তারা নিজেদের বৈষ্ণব বলে; কিন্তু বিষ্ণু বা কৃষ্ণ বা তাঁর কোনো অবতার তারা মানে না। তারা বিশ্বাস করে শুধু দেহতে। তাদের আর একটা নাম হলো সহজিয়া, ভারতবর্ষে শেষ চার শতাব্দী ধরে মহাযান বৌদ্ধদের যে-অস্তিত্ব ছিলো তার থেকেই এ-নামের সম্প্রদায় দেখা দিয়েছিলো।
মহামহোপাধ্যায়ের-এর এই শেষ মন্তব্যটি স্পষ্টভাবে বোঝা গেলো না। তিনি বলছেন, লোকায়ত মত-ই আজো নানান নামের অন্তরালে, নানান সম্প্রদায় হিসাবে, আমাদের দেশে টেকে রয়েছে। তার মধ্যে একটির নাম হলো সহজিয়া। আবার, সেই সঙ্গেই তিনি বলছেন, এই সহজিয়া নামটিই মহাযান বৌদ্ধদের একটি সম্প্রদায়ের নাম। এ-কথা কেমনভাবে সম্ভব হতে পারে? কিংবা, যদি সত্যিই তাই হয় তাহলে বৌদ্ধদের সঙ্গে লোকায়তিকদের সম্পর্কটা ঠিক কী রকম? মহামহোপাধ্যায়ের মন্তব্য থেকে এই জাতীয় নানান প্রশ্ন ওঠে।
কিন্তু এ-সব প্রশ্নের চেয়ে ঢের আকস্মিক মনে হবে ওই ভাবে একনিশ্বেসে লোকায়তিকদের নামের সঙ্গে কাপালিকদের নাম উল্লেখ করা। শুধু তাই নয়, মহামহোপাধ্যায় বলছেন, লোকায়তিক সম্প্রদায়গুলি যে-ভাবে আজো আমাদের দেশে টেকে আছে, তারা শুধুই যে দেহতত্ত্বে আস্থাবান তাই নয়, তাদের আর একটি পরিচয় হলো কামসাধনা : স্ত্রী-পুরুষে মিলন!
তার মানে, খুব ব্যাপকভাবে আমরা যে-মতবাদগুলিকে বলি তান্ত্রিক মতবাদ। বামাচার।
কিন্তু বস্তুবাদের সঙ্গে এই বামাচারের সম্পর্ক কী? এ-প্রশ্নকে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। কেননা, মহামহোপাধ্যায় যে ওইভাবে বামাচারী কাপালিকদের সঙ্গে লোকায়তিকদের এক করে দিচ্ছেন তার পেছনে রয়েছে পুরোনো পুঁথির নজির। পুরোনো পুঁথিতে লেখা আছে, লোকায়ত আর কাপালিক একই।(৩৯) এ-নজিরকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
———————-
৩৭. M. Monier-Williams SED 906.
৩৮. H. P. Shastri L 6.
৩৯. Ibid.
১০. বামাচার-এর তাৎপর্য
তাহলে লোকায়ত দর্শন নিয়ে আলোচনা করতে হলে নানান রকমের প্রশ্ন না তুলে উপায় নেই। প্রথমত, বিপক্ষের লেখায় লোকায়তিকদের সম্বন্ধে যে সব ছোটো ছোটো বিচ্ছিন্ন সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে শুধুমাত্র সেগুলি থেকেই লোকায়ত দর্শনের বিলুপ্ত রূপটিকে খুঁজে পাবার আশা নেই। পুঁথিত গণ্ডি পেরিয়ে দেশের মানুষদের দিকেও চেয়ে দেখতে হবে—বিশেষ করে সেই সব মানুষদের, যারা চাষ করে। কেননা, তাদের মধ্যে লোকায়ত দর্শন আজো বেঁচে রয়েছে,–যদিও সমাজের সদরমহলের বিদগ্ধ পুঁথিপত্রের আসরে কোনো এককালে তার যে-স্থান ছিলো সে-স্থান আজ আর নেই!
এইভাবে লোকায়ত-দর্শনের উৎস সন্ধানে বেরুলে দেখা যায় বামাচারী মতামত ও আচার-আচরণের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। আর ঠিক এইখানটিতে এসেই যেন ঠেকে যেতে হয়। কেননা, আমাদের আজকালকার শিক্ষিত ও মার্জিত রুচিবোধের কাছে ওই সব মতবাদ ও আচরণের মতো কদর্য ও বিকৃত ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না!
তাহলে উপায়? আমাদের আধুনিক রুচিবোধের খাতিরে লোকায়তের উৎস অনুসন্ধানটাকে কি ছেড়ে দিতে হবে?
অবশ্য, আর একটা সম্ভাবনাও বাকি থাকে। এমন তো হতেই পারে যে আমাদের রুচিবোধ, নীতিবোধ নেহাতই একালের ব্যাপার। অর্থাৎ কিনা, সমাজ-বিকাশের উন্নততর পর্যায়ের অবদান। অপরপক্ষে, বামাচারী মতাদর্শ সেকালের ব্যাপার। যদিও আজকের দিনেও তা টেকে রয়েছে তবুও তা অনেকাংশেই আজকের পৃথিবীরই আনাচে-কানাচে আদিম মানুষদের পক্ষে টেকে থাকবার মতোই। তার মানে এ-ধরনের ধ্যানধারণার উৎস সমাজ-বিকাশের অনেক পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ের মধ্যে। একালের রুচিবোধ ও নীতিবোধকে সেকালের পক্ষেও সত্য বলে মনে করবার কোনো কারণ নেই। আর যদি তাই হয় তাহলে এমনটা হওয়া সত্যিই অসম্ভব নয় যে, যে-উদ্দেশ্য থেকে সমাজের ওই পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ে বামাচারী ধ্যানধারণার জন্ম হয়েছিল তা বুঝতে পারা যাবে না শুধুমাত্র আধুনিক কালের লাম্পট্য-ব্যবহারকে মনে রাখলে।
কিন্তু এই বামাচারী ধ্যানধারণাগুলির উৎস সন্ধান করা যাবে কী ভাবে? কোন সূত্রে এগিয়ে?
১১. সিদ্ধিদাতার অনুসরণে
খবর পাওয়া গেলো, তান্ত্রিক সাহিত্যের আসর জমিয়ে রয়েছেন খোদ গণেশ বা গণপতি। তন্ত্ররাজ্যে তাঁর এমনই খ্যাতি যে অষ্টশতনামের মহিমা না জুটলেও অন্তত পঞ্চাশটি(৪০) চিত্তাকর্ষক নাম তাঁর ঠিকই জুটেছিলো।
তাই আশা হলো, সিদ্ধিদাতার শরণাপন্ন অলে হয়তো তন্ত্র-রহস্যও বুঝতে পারা অসম্ভব হবে না।
আর সত্যিই যেন সিদ্ধিদাতা! আপনি যদি গণপতির পদচিহ্ন অনুসরণ করে এগোতে থাকেন তাহলে সেকালের ভারতবর্ষের কতো অপরূপ দৃশ্যই না দেখতে পাবেন—দেখতে পাবেন কতো সব আশ্চর্য মানুষ, কতোই না তাদের আশ্চর্য বিশ্বাস!
এমনকি, ভারতীয়-দর্শনের অনেক জটিল রহস্যের কিনারা পাবার চেষ্টাকে এই গণপতিই হয়তো শেষ পর্যন্ত সফল করতে পারেন।
শুধুমাত্র সংকীর্ণ অর্থে লোকায়তিক বা চার্বাক দর্শনের সমস্যার কথাই বলছি না। বামাচারী ধ্যানধারণার উৎস নিয়ে সমস্যাটুকুও নয়। সিদ্ধিদাতার শরণাপন্ন হলে ভারতীয় দর্শনের আরো অনেক জটিল প্রশ্নের কিনারা হতে পারে।