এই তত্ত্বটিকে বোঝবার জন্যে ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে দলিলপত্র এতো রয়েছে যে অন্য কোনো দেশে তা খুঁজে পাওয়া সম্ভবই নয়। তার কারণ, আমাদের দেশে সমাজ-ইতিহাসের ওই পর্যায়ের বিকাশ—যে-পর্যায়ে ধীরে ধীরে পরান্নজীবী শ্রেণীর উৎপত্তি—খুবই দীর্ঘদিনস্থায়ী হয়েছিলো। ফলে অজস্র রচনায় তা প্রতিফলিত হয়েছে। অন্য কোনো দেশে এমনটা হয়েছে কিনা খুবই সন্দেহের কথা। আর সেই কারণেই দলিলগুলি সত্যিই মহামূল্যবান। কেননা, ভারতীয় ইতিহাসে যে-কথা স্পষ্ট ও প্রকট ভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তারই সাহায্যে অন্যান্য দেশের ইতিহাসে যে-কথা অস্পষ্ট আর আবছা হয়ে গিয়েছে তা বুঝতে পারবার সুযোগ হতে পারে।
ভাববাদের উৎস নিয়ে আলোচনা তুলতে হবে। কিন্তু আমাদের যুক্তির এই অবসথায় যেটুকু কথা একান্ত প্রাসঙ্গিক সেটুকু হলো, জনসাধারণের দর্শন আর বস্তুবাদী দর্শ্ন এই দুটি কথা আমাদের দেশে কেন দুটো আলাদা নাম পায় নি।
যারা মাটি কামড়ে পড়ে ছিলো মাটির পৃথিবীটাকেই তারা সত্যি বলে মেনেছে। লোকায়তিকদের কাছে বার্ত্তা বা চাষবাসের চেয়ে বড়ো বিদ্যা আর কিছুই ছিলো না। আর তাই জন্যেই তাদের চেতনায় এই মূর্ত মাটির পৃথিবীই সবচেয়ে বড়ো সত্যি।
তাই বলেছিলাম, খুব মোটা কথায় বললে বলা যায়, দেশের সাধারণ মানুষ খেটে খাওয়ায় বিশ্বাস হারায় নি। আর তাই জন্যেই তারা বস্তুবাদী দর্শনকে অমনভাবে আপন করে নিয়েছিলো।
সত্যিই কী আশ্চর্য ওই ‘লোকায়ত’ নামটি! এই নামের মধ্যেই খেটে খাওয়ার ইঙ্গিতটুকুও খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। কেননা, নামটার মূলে রয়েছে দুটি শব্দ : লোক + আয়ত। তার মধ্যে আয়ত কথাটা কী করে পাওয়া সম্ভব তাই ভাবতে ভাবতে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত(৩৬) বলছেন ‘আ+যৎ+অ’ করে কথাটা সিদ্ধ হওয়া অসম্ভব নয়। এখন ‘আ’ উপসর্গের অর্থ হলো ‘সম্যক ভাবে’। আর ‘যৎ’ ধাতুর মানে হলো চেষ্টা করা, উদ্যম করা, কাজ করা। তাই আয়ত বলতে ‘সম্যকভাবে চেষ্টা করবার’ অর্থও বোঝাতে পারে বই কি। এই তো গেলো ‘আয়ত’ শব্দের মানে। আর ওই ‘লোক’ বলে কথাটার মানে কী? এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে মনিয়ার-উইলিয়াম্স্(৩৭) বলছেন, ‘লোক’ কথাটির সঙ্গে লাতিন শব্দ locus এবং লিথুনিয়ান laukas শব্দের তুলনা করা যায়। লিথুনিয়ান শব্দটির মানে, চাষের জমিই। আর লাতিন শব্দটির মানে, a clearing of forest—চাষের জন্য জঙ্গল-সাফ-করা জায়গা। সংস্কৃততেও ‘লোক’ শব্দের আদি ও অকৃত্রিম অর্থের সঙ্গে যে চাষের-জমির সম্পর্ক ছিলো না, এমন কথাও খুব জোর করে বলা যায় না। কেননা মনিয়ার-উইলিয়াম্স্-ই বলছেন, শুরুতে লোক শব্দের আগে একটা উ থাকতো—উলোক। এই উলোক=উরুলোক। এবং তার মানেই হলো জমি, মাঠ ইত্যাদি।
তাই লোকায়ত মানেও যা, বার্ত্তাকেই একমাত্র বিদ্যা মনে করাও তাই। একই কথা। কৃষকদের কথা।
ওরা কাজ করে। ওরা মাটির বুকে ফসল ফলায়। তাই ওদের চেতনার নাম হলো লোকায়ত।
——————————
৩৬. S. N. Dasgupta op. cit. 3:514
০৯. লোকায়ত-দর্শন আজো বিলুপ্ত হয় নি
বিপক্ষের লেখায় ঘৃণা আর বিদ্রুপের খোরাক যোগাবার মতো দু’চারটে টুকরো কথা বাকি রেখে এই বার্ত্তা-বাদী সম্প্রদায়টির সমস্ত পুঁথি দেশ থেকে বিলুপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু ওই বার্ত্তা-নিয়ত মানুষগুলি? তারা তো আর সত্যিই সেই সঙ্গে দেশ থেকে বিলুপ্ত হয় নি। তাই লোকায়তিক পুঁথিপত্র দেশ থেকে বিলুপ্ত হলেও লোকায়তিক চেতনাটি বিলুপ্ত হবার কথা নয়।
আর সত্যিই তা হয় নি।
এই সত্যটি আবিষ্কার করলেন, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তাঁর আবিষ্কার সাম্প্রতিক ভারততত্ত্বে এক প্রকাণ্ড বিস্ময়।
তিনি,–এবং বোধহয় তাঁর মতো বড়ো ভারততাত্বিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম,–অনুভব করলেন যে শুধুমাত্র লিখিত দলিলের রাজ্যে বাস করে দেশের চিন্তাধারার পুরো পরিচয় পাওয়া যাবে না। শুধু তাই নয়। তাছাড়াও তিনি বুঝেছিলেন যে, যে-মুষ্টিমেয় মানুষ সমাজের সদর-মহলকে আলো করে রেখেছেন,–যাঁরা জ্ঞানী, যাঁরা গুণী, যাঁরা বিদ্বান, যাঁরা বিদগ্ধ,–শুধুমাত্র তাঁদের ধ্যানধারণার খবর পেলেই দেশের ধ্যানধারণাগুলিকে পুরোপুরি জানা সম্ভব হবে না। কেননা, দেশের পিছিয়ে-পড়া অঞ্চলগুলিতে এবং সমাজের নিচের তলায় মানুষদের মধ্যে আজো বেঁচে রয়েছে এমন সব ধ্যানধারণা যার সঙ্গে উপরতলার আভিজাতিক ধ্যানধারণাগুলির মিল হয় না। এবং মহামহোপাধ্যায়ের পক্ষে যেটা সবচেয়ে আশ্চর্য আবিষ্কার সেটা হলো, দেশের ওই পিছিয়ে-পড়া অঞ্চলগুলিতে, ওই ছোটো জাতের মানুষদের মনে, যে-চেতনা আজো সত্যিই বেঁচে রয়েছে তা আসলে লোকায়তিক চেতনাই। মহামহোপাধ্যায় লিখছেন :
The influence the Lokayatikas and of the Kapalikas is still strong in India. There is a sect, and a large one too, the followers of which believe that deha or the material human body is all that should be care for; their religious practices are concerned with the union of men and women and their success (siddhi) varies according to the duration of the union. These call themselves Vaisnavas, but they do not believe in Vishnu or Krishna or his incarnations. They believe in deha. They have another name, Sahajia, which is the name of a sect of Buddhists which arose from Mahayana in the last four centuries of their existence in India.(৩৮)
Page 7 of 238