ভেবে দেখা দরকার বিশেষ করে একটি বিষয়ের কথা : অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে শাসনক্ষমতার সম্পর্কটা শাসক-শ্রেণীর সাহিত্যে উলটো ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে কিনা? অর্থাৎ, প্রশ্ন হলো, অধ্যাত্মবাদের দরুনই শাসনক্ষমতা, না, শাসনক্ষমতার দরুনই অধ্যাত্মবাদ? এ-বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মীমাংসা যাই হোক না কেন, অন্তত উপনিষদে যেটুকু কথা লেখা রয়েছে সেটুকুকেও কেউই উড়িয়ে দিতে পারবে না : অধ্যাত্মবাদ শুধুমাত্র শাসক-শ্রেণীর দর্শনই নয়, সেই শ্রেণীর কাছে শাসনের হাতিয়ারও।
————-
২৫. S. Radhakrishnan HPEW 1:21.
২৬. মৈত্রী উপনিষদ ৭.৮.৯।
২৭. বিষ্ণুপুরাণ ৩.১৮।
২৮. মনু ৪.৩০।
২৯. মনু ২.১১ ইত্যাদি।
০৭. অধ্যাত্মবাদের উৎস
অধ্যাত্মবাদী দর্শনের উৎস কেন শুধুমাত্র শাসক-শ্রেণীর মানুষের চেতনায়?—এ-প্রশ্ন পরে তোলা যাবে। আপাতত তার চেয়েও জরুরী প্রশ্ন হলো, বস্তুবাদী দর্শনের সঙ্গে জনসাধারণের নাড়ির যোগটা নিয়ে। এই যোগাযোগ সম্ভব হলো কেমন করে?
ভারতীয় দর্শনের দলিলপত্র থেকেই এ-প্রশ্নের একটা ভারি আশ্চর্য জবাব পাওয়া যাচ্ছে। খুব মোটা ভাষায় বললে বলা যায়, দেশের সাধারণ মানুষ খেটে খাওয়ায় বিশ্বাস হারায় নি, তাই।
কিন্তু খেটে খাবার প্রশ্ন উঠছে কেন? দার্শনিক আলোচনার আসরে এ-ধরনের প্রসঙ্গ খুবই স্থূল আর খাপছাড়া শোনায় না কি?
তবু উপায় নেই। লোকায়ত দর্শনের ধ্বংসস্তুপ থেকে যে-দু’চারটে ভাঙা-চোরা চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে তার থেকেই ও-দর্শনের আসল রূপটিকে চেনবার চেষ্টা করতে হবে। আর এই সব চিহ্নের মধ্যে একটি চিহ্ন সত্যিই ওই খেটে খাবার প্রসঙ্গই তুলছে!
চিহ্নটা কী রকম?
বার্হস্পত্যসূত্রম(৩০), প্রবোধচন্দ্রোদয়(৩১) ইত্যাদি পুরোনো কালের একাধিক পুঁথিপত্রে লেখা আছে, লোকায়ত মত অনুসারে বার্ত্তাই হলো একমাত্র বিদ্যা। (অবশ্যই, শুধু বার্ত্তার কথাই নয়, তার সঙ্গে দণ্ডনীতিও।) লোকায়ত দর্শনের রহস্য উদঘাটন করবার ব্যাপারে এই সূক্ষ্ম সূত্রটি যে কতো জরুরী সে-কথায় আমরা বারবার ফিরতে বাধ্য হবো। আপাতত দেখা যাক, এই কথাটি থেকেই খেটে খাবার প্রসঙ্গ কেন উঠতে বাধ্য।
বার্ত্তা মানে কী? কৌটিল্য(৩২) বলছেন, বার্ত্তা মানে হলো কৃষি, পশুপালন আর বাণিজ্য। অবশ্যই, বাণিজ্য বলতে আজকাল আমরা যা বুঝি কৌটিল্যের যুগেও,–অর্থাৎ যীশুখ্রীষ্ট জন্মাবার প্রায় সোয়া তিন শ’ বছর আগেও,–তাই বোঝাতো কিনা খুবই সন্দেহের কথা। কিন্তু সে-কথা ছেড়ে দিলেও এ-বিষয়ে নিশ্চয়ই কোনো তর্ক উঠবে না যে বার্ত্তা শব্দের মুখ্য অর্থ হলো চাষবাস।
তাহলে, লোকায়তিকদের কাছে চাষবাসের কথাটাই ছিলো সবচেয়ে জরুরী।
এই মনোভাবটির সঙ্গে দেশের শাসকশ্রেণীর মনোভাবটির যে কতোখানি তফাত তা স্পষ্টভাবে মনে রাখা দরকার। মনু(৩৩) বলছেন, ব্রাহ্মণের পক্ষে কৃষিকাজ নিষিদ্ধ। একবার নয় আধবার নয়, বারবার বলছেন। আর শুধু মনুর আইনই নয়, পুরোনো কালের অন্যান্য আইনের বইতেও(৩৪) সরাসরি লেখা আছে যে বেদজ্ঞানের সঙ্গে কৃষিকর্মের সঙ্গতি নেই।
শ্রম বা কর্মজীবন সম্বন্ধে শাসক-সমাজের মনোভাবটা এই জাতীয় আইন-কানুন থেকেই আন্দাজ করা যাবে। এবং এইখান থেকে মূলসূত্র পেয়েই আরো একটি কথা বুঝতে পারা যাবে : ওই শাসক সমাজের দার্শনিক চেতনা যখন চূড়ান্ত ভাববাদের রূপ পেলো তখন কেন ঘোষিত হলো যে, যে-কোনো রকম কর্মই প্রকৃত দার্শনিক জ্ঞানের পক্ষে অন্তরায় মাত্র(৩৫)।
—————————–
৩০. S. N. Dasgupta HIP 3.532.
৩১. Ibid.
৩২. অর্থশাস্ত্র (রাধাগোবিন্দ বসাক) ১:৬।
৩৩. মনু ১০.১১৬।। cf. SBE 25:86, 106sq., 420sq., 420n.
৩৪. SBE 14:176
৩৫. শঙ্করভাষ্য ব্রহ্মসূত্র : ১.১.১।
০৮. ওরা কাজ করে
জ্ঞানের সঙ্গে কর্মের সম্পর্ক নিয়ে ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে সুদীর্ঘ আলোচনা হয়েছিলো। তার বিস্তারিত দলিলপত্র সংগ্রহ করা কঠিন নয়। সাধারণভাবে, দর্শনের একটি মূল সমস্যাকে বোঝবার জন্যে এই দলিলগুলি মহামূল্যবাদ। দর্শনের ওই মূল সমস্যাটি হলো বস্তুবাদ-বনাম-ভাববাদের সমস্যা : চেতনা আগে না বস্তুজগৎ আগে, চেতনা প্রাথমিক না বস্তু প্রাথমিক? আমাদের দেশের দার্শনিক পরিভাষায় সমস্যাটা অনেক সময় চেতনকারণবাদ-বনাম-অচেতনকারণবাদ হিসাবে দেখা দিয়েছে : চেতনপদার্থকেই বা চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্মকেই পরম সত্য বলবো, না, অচেতন পদার্থকেই পরম সত্য বলা হবে?
আমাদের দেশের দার্শনিক দলিলগুলিকে বিচার করলে দেখা যায়, চিন্তানায়কদের সঙ্গে স্বাভাবিক কর্মজীবনের যোগসূত্র যতোই বিচ্ছিন্ন হয়েছে ততোই তাদের চেতনা থেকে বিপুপ্ত হয়েছে বহির্বাস্তবের অমোঘ যাথার্থের কথা। অর্থাৎ কিনা, কর্মকে নীচবৃত্তি মনে করতে পারবার দরুনই মানুষ ভাববাদের দিকে অগ্রসর হতে পেরেছে। কিন্তু সব মানুষই তো আর কর্মকে খাটো করতে পারে না। তাহলে যে সমাজ টিকবে না, পৃথিবীর বুক থেকে মানুষের চিহ্ন মুছে যাবে। অন্ন-উৎপাদনের দায়িত্বটা অন্তত একদল মানুষকে গ্রহণ করতেই হবে। বস্তুত, যতোক্ষণ না একদল মানুষ ওইভাবে অন্ন উৎপাদনের দায়িত্বটা পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারে ততোক্ষণ পর্যন্ত আর একদলের পক্ষে এ-কাজকে হীন, অধমের লক্ষণ বলে মনে করা সম্ভবই নয়। তাই কর্মকে শুধু সেই শ্রেণীর মানুষই খাটো করতে পারে যে-শ্রেণী কিনা কর্মের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে। আর ঠিক এই কারণেই ভাববাদী বা অধ্যাত্মবাদী দর্শনে সমাজের সব-শ্রেণীর মানুষের চেতনাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তার বদলে পাওয়া যায় শুধু মাত্র সেই শ্রেণীর চেতনা যে শ্রেণী কর্মের দায়িত্ব গ্রহণ না করেও অপরের কর্মফলটুকু উপভোগ করবার অধিকার পেয়েছিলো।