ভারতীয় দর্শনের যে-কোনো একটি পাঠ্যপুস্তক উল্টে দেখতে পারেন। দেখবেন লেখা আছে, লোকায়ত দর্শন ছিলো মাত্র মুষ্টিমেয় অধঃপাতে-যাওয়া সুখান্বেষীর মনের কথা। নিছক নিজেদের ভোগবিলাস ছাড়া তারা আর কোনো আদর্শকেই আদর্শ বলে মানতো না। তারা শুধু ঘি খাবার তালেই ঘুরতো,—তা সে ধার করেই হোক আর যে করেই হোক!
এ-হেন মতবাদ যে নৈতিক চরিত্রের পতন ঘটাবে, সে-কথা কি আর খুলে বলবার দরকার আছে? তবু দেখবেন, ভারতীয় দর্শনের বেশির ভাগ বইতে লেখা আছে, সেকালের ঋষিরা লোকায়ত দর্শনের এই ভয়াবহ পরিণামটির কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার ব্যাপারেরো আলস্যের পরিচয় দেন নি। কেননা, লোকায়ত দর্শনের উৎপত্তি নিয়ে মৈত্রায়ণ উপনিষদে(২৬) একটি অদ্ভুত গল্প আছে। একবার নাকি অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে দেবতারা কিছুতেই পেরে উঠছিলেন না। তখন দেবগুরু বৃহস্পতি এক ফন্দি আঁটলেন। তিনি অসুরগুরু শুক্রের ছদ্মবেশ ধরে অসুরশিবিরে প্রবেশ করে প্রচার করলেন এই বস্তুবাদী মতবাদ। ফলে অসুরদের নৈতিক পতন ঘটলো, আর তারই দরুন তারা দেবতাদের কাছে পরাজিত হলো।
লোকায়ত দর্শনকে দেশের লোকের সামনে এই ভাবে এক ভয়াবহ ব্যাপার বলে প্রকার করবার চেষ্টা শুধু উপনিষদে নয়, পৌরাণিক সাহিত্যেও। কাহিনীটা মোটের উপর একই(২৭)।
অবশ্যই এই কাহিনীর মধ্যে দেবগুরুর নিজস্ব যে-নীতিবোধের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে তা সত্যিই ভালো না মন্দ, সে-প্রশ্নের আলোচনা উপনিষদাদির পক্ষে প্রাসঙ্গিক নয়। কেননা কাহিনীটির মূল উদ্দেশ্য হলো, লোকায়ত দর্শন সম্বন্ধে একটি ভীতি প্রচার করা। শুধুমাত্র এই ভীতিপ্রচারই নয়। এমন কি, সেকালের আইন-কর্তারাও এ-দর্শনের বিরুদ্ধে রীতিমতো আইনগত ব্যবস্থা অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন। প্রমাণ মনুস্মৃতি। মনু(২৮) বলেছেন, অতিথিযোগ্য কালেও লোকায়তিকেরা (হৈতুকাঃ = বেদবিরোধিতর্কব্যবহারিণঃ) উপস্থিত হয় তাহলে এমন কি বাক্যদ্বারাও এদের সম্ভাষণ করা চলবে না। লোকায়তিকদের বিরুদ্ধে মনুর আরো নানারকম কঠিন কঠিন বিধান(২৯) আছে।
তবুও, লোকায়ত নামটির অর্থ বিচার করতে গিয়েই দেখা গেলো, আতঙ্কজনক গল্প প্রচার করে, আইন করে, বই পুড়িয়ে—আরো হাজারো অকম ব্যবস্থা অবলম্বন করে সাধারণ মানুষের মন থেকে সেকালের শাসকেরা এই দর্শনটি সত্যিই সরাতে পারে নি। লোকায়ত দর্শন মানে শুধু বস্তুবাদ নয়, জনগনের দর্শনও। জনসাধারণের সঙ্গে বস্তুবাদী দর্শনের সম্পর্ক যে কতো নিবিড় সে কথা আজো আমাদের দেশে এই নামটির মধ্যেই পরিষ্কার ভাবে টিকে রয়েছে।
তাই এ-কথা বলা মোটেই ঠিক নয় যে ভারতীয় দর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বাস্তব জগৎটাকে ছেড়ে মানুষের অধ্যাত্ম জগৎটির দিকেই মনোযোগ দেবার চেষ্টা।
তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে ভারতবর্ষে অধ্যাত্মবাদী দর্শনের বিকাশ ঘটে নি। নিশ্চয়ই ঘটেছিল। কিন্তু সে-দর্শন ছিলো একটি সংকীর্ণ শ্রেণীর মধ্যে আবদ্ধ, দেশের জনসাধারণের সঙ্গে তার নাড়ির যোগ ছিলো না। সেই সংকীর্ণ শ্রেণীর হাতে দেশের শাসন-ক্ষমতা ছিলো বলেই ওই অধ্যাত্মবাদী দর্শনের পুঁথিপত্রগুলিকে পুড়িয়ে ফেলবার কোনো কারণ তো ঘটেই নি; বরং এ-জাতীয় দার্শনিক রচনার প্রচার যাতে প্রশস্ত হয় তার জন্যেও দেশে নানাবিধ ব্যবস্থা ছিলো। কিন্তু তাই বলে শুধুমাত্র ওই ধরনের পুঁথিপত্রগুলিকেই দেশের দার্শনিক চিন্তাধারার একমাত্র পরিচায়ক মনে করাটা কি ঠিক? যে-সব পুঁথি বিলুপ্ত হয়েছে সেগুলির সাক্ষ্যকেও তো উড়িয়ে দেওয়া উচিত নয়।
আমাদের দেশে অধ্যাত্মবাদী দর্শন যে শুরুতে শুধুমাত্র শাসন-শ্রেণীর চেতনাদেই প্রতিভাত হয়েছিলো এ-কথা উপনিষদের ঋষিরা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষাতেই বলে গিয়েছেন। প্রমাণ : ছান্দোগ্য উপনিষদের শ্বেতকেতু-প্রবাহণ-সংবাদ (।।৫।৩।।)। এখানে উপনিষদের গল্পটির মূল কথাটুকু উল্লেখ করা যাক :
শ্বেতকেতু আরুণেয় এক সময়ে পাঞ্চাল সমিতিতে গিয়েছিলেন। সেখানে প্রবাহণ জৈবলি তাঁকে প্রশ্ন করলেন : হে কুমার, তোমার পিতা তোমাকে উপদেশ দিয়েছেন কি? শ্বেতকেতু বললেন, নিশ্চয়ই দিয়েছেন। প্রবাহণ তখন শ্বেতকেতুকে পরলোকতত্ত্ব ও অধ্যাত্মবিদ্যা-সংক্রান্ত পরের পর পাঁচটি প্রশ্ন করলেন। শ্বেতকেতু একটিরও জবাব দিতে পারলেন না। তখন প্রবাহণ বললেন, তবে কেন বলছিলে যে তুমি উপদিষ্ট হয়েছো? ফলে মনের দুঃখে শ্বেতকেতু পিতার কাছে ফিরে গিয়ে বললেন, সেই রাজন্যবন্ধু আমাকে পাঁচটি প্রশ্ন করেছিলেন, আমি তার একটিরও জবাব দিতে পারি নি। পিতা স্বীকার করলেন, তিনি নিজেও এ-সব প্রশ্নের উত্তর জানেন না—জানলে নিশ্চয়ই উপদেশ দিতেন।
তারপর গৌতম (শ্বেতকেতুর পিতা) নিজেই রাজভবনে গেলেন। রাজা অভ্যাগতকে সমাদর করলেন। সকলে রাজা সভায় উপস্থিত হলে গৌতমও সেখানে গেলেন। রাজা তাঁকে বললেন, মনুষ্যসম্বন্ধী বিত্ত আপনারই থাকুক। আপনি আমার ছেলের কাছে যে-কথা বলেছিলেন আমাকে তাই বলুন। শুনে রাজা বিষণ্ণ হলেন।
রাজায় আজ্ঞায় গৌতম সেখানে দীর্ঘকাল বাস করলেন। তারপর রাজা তাঁকে বললেন, আপনি যে আমাকে সেই বিষয় জিজ্ঞাসা করেছিলেন—আপনার পূর্বে পুরাকালে কোনো ব্রাহ্মণই এই বিদ্যা লাভ করে নি। (এ-বিদ্যা কেবলমাত্র ক্ষত্রিয়গণেরই জানা ছিলো)। এই জন্যেই সর্বত্র রাজ্যশাসন করবার ক্ষমতা ক্ষত্রিয়দের হাতেই রয়েছে।
“তন্মাধ্য সর্ব্বেষু লোকেষু ক্ষত্রস্যৈব প্রশাসনমভূৎ”—ওই অধ্যাত্মবিদ্যার দরুনই সর্বত্র ক্ষত্রিয়দের শাসনক্ষমতা ছিলো। ক্ষত্রিয় বলতে সে কালের শাসক-শ্রেণী এ-বিষয়ে নিশ্চয়ই সন্দেহ নেই। প্রশাসন বলতে যে রাজ্য শাসনই বোঝাচ্ছে এ-কথা ডয়সন স্পষ্ট ভাবেই প্রমাণ করেছেন। ভাববাদ বা অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে শাসক-শ্রেণীর সম্পর্ক শাসক-শ্রেণীরই সাহিত্যে আর কোথাও এমন স্পষ্টভাবে স্বীকার করা হয়েছে কিনা খুবই সন্দেহের কথা।