কিন্তু সে-সব কথা না হয় আপাতত ছেড়েই দিলাম। আপাতত না হয় মেনেই নিলাম যে জনসাধারণ মূঢ়, প্রাকৃত, উচ্চাঙ্গের চিন্তার অযোগ্য। আর তার জন্যেই তারা ও-রকম স্থূল কথাবার্তাকেই,–বস্তুবাদকেই,–সত্য বলে মনে করেছে। তাহলেও, অন্তত এটুকু তো মানতেই হবে যে, যে-কোনো কারণেই হোক না কেন, আমাদের দেশে বস্তুবাদী দর্শন আর জনসাধারণের দর্শন—দুটো কথা আলাদা কথা নয়। তার বদলে, একই কথার এপিঠ-ওপিঠ। কেননা, প্রাচীনেরাও বারবার লিখে গিয়েছেন, আর আধুনিক পণ্ডিতেরাও স্বীকার করছেন, লোকায়ত কথার মানে একটা নয়। জনসাধারণের দর্শন। বস্তুবাদী দর্শন। দুই-ই।
—————
১৭. T. W. Rhys Davids DB 2:167. cf. S. N. Dasgupta op. cit. 3:513
১৮. S. N. Dasgupta op. cit. 3:512n
১৯. Ibid 3:512
২০. সর্বদর্শনসংগ্রহ ৫।
২১. হরিভদ্রের ষড়্দর্শনসমুচ্চয়ের গুণরত্ন ও মণিভদ্রের টীকা দ্রষ্টব্য।
০৫. ভারতের ঐতিহ্য
সেখান থেকে একালের কথায় আসা যাক। একালের কথাটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কেননা, লোকায়ত দর্শনের পুঁথিপত্রগুলি যতোকাল আগেই বিলুপ্ত হয়ে যাক না কেন, হাজার হোক আমরা তো আজকের দিনে এ-আলোচনার তাৎপর্য কতোখানি সে-কথাও ভেবে দেখা দরকার বই কি।
আজকের দিনে আমরা বারবার শুনতে পাই, বস্তুবাদী দর্শনটার সঙ্গে আমাদের দেশের প্রাচীন সভ্যতার কোনো সম্পর্ক নেই। এ-দর্শন নেহাতই বিদেশী ব্যাপার, পশ্চিমী ব্যাপার—দেশের জমিতে এর কোনো শিকড় ছিলো না। আমাদের দেশের ইতিহাস আলাদা, জীবনের আদর্শ আলাদা,–সব কিছুই অন্য রকমের। পশ্চিমের আদর্শটা হলো বস্তুবাদী আদর্শ, ভোগের আদর্শ,–ভুল আদর্শ। তারই মোহে পড়ে আজকের পশ্চিমী সভ্যতা কী রকম উন্মাদের মতো আত্মনাশের পথে এগিয়ে চলেছে! তার বদলে, আমাদের দেশের আদর্শ হলো ত্যাগের আদর্শ, আধ্যাত্ম-চেতনার আদর্শ। আজ বরং আমাদের দেশের এই আদর্শকেই গ্রহণ করতে পারলে পশ্চিমী সভ্যতা অমন ভয়াবহ ধ্বংসের পথ থেকে ফিরে আসতে পারবে। কিন্তু তার বদলে আমরা যদি আমাদের নিজস্ব আদর্শটিকে ছেড়ে এই প্রাচ্যের জমিতে ওই পশ্চিমী বস্তুবাদের বীজ বুনতে যাই তাহলে অঘটন ঘটবে, জন্মাবে এক বিষবৃক্ষ,–তার ফল আমাদের কল্যাণ করবে না।
এই কথাগুলিই এতোবার, এতোভাবে(২২), আমাদের বলা হয়েছে যে শুনতে শুনতে অনেকেই মনে করেছেন, সত্যিই হয়তো বা তাই। সত্যিও বুঝি আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের মধ্যে বস্তুবাদী দর্শনের কোনো স্থান নেই, সত্যিই বুঝি আমাদের দেশের জমিতে শুধু অনাবিল অধ্যাত্মবাদেরই বিকাশ ঘটেছে।
অথচ এতোগুলি কথার মধ্যে একটিও সত্যি কথা নয়।
প্রথমত, পাশ্চাত্য দর্শন যে বস্তুবাদী দর্শন, এই কথাটাই ভুল। আজকের পাশ্চাত্য দেশগুলি যে বস্তুবাদের মোহে পড়েই অমন আত্মনাশের পথে এগিয়ে চলেছে, সে-কথাটা আরো বেশি ভুল। আত্মনাশের আয়োজন যে নেই তা নয় : পৃথিবীর বুক থেকে একটা মহাযুদ্ধের ক্ষত শুকোতে না শুকোতে শোনা যায় আর একটা মহাযুদ্ধের দামামা বেজে উঠছে। কিন্তু তার সঙ্গে বস্তুবাদী দর্শনের সম্পর্কটা কী রকম? ঐকান্তিক বিরোধের সম্পর্কই। কেননা আজকের দিনে যাঁরা সত্যিই এই মৃত্যুর মহাযজ্ঞের বড়ো বড়ো যজমান তাঁদের কাছে বস্তুবাদ দর্শনই বিরাট বিভীষিকার মতো। তাই তাঁদের মুখপাত্ররা বস্তুবাদকে হাজারবার খণ্ডন করেও স্বস্তি পান না, আবার নতুন করে খণ্ডন করবার জন্যে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন(২৩)। এবং বস্তুবাদকে খণ্ডন করে অধ্যাত্মবাদী আর ভাববাদী মতবাদকে রকমারি মুখোস পরিয়ে রকমারি উপায়ে প্রচার করতেই তাঁরা আজ ব্যস্ত। অবশ্যই, আজকের ইয়োরোপের দার্শনিক পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করবার অবকাশ আমরা এই বইতে পাবো না। যাঁরা সে-বিষয়ে আলোচনা করেছেন, এবং দেখাচ্ছেন আজকের দিনে স্বার্থান্ধ যুদ্ধবাদীরা কী ভাবে বস্তুবাদকে ধূলিস্যাৎ করে তারই ধ্বংসস্তুপের উপর অধ্যাত্মবাদ আর ভাববাদকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়,–পাদটীকায় তাঁদের বই-এর নাম উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হতে হলো(২৪)।
আমাদের বর্তমান আলোচনায় বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক হলো অপর প্রশ্নটি : ভারতীয় দর্শন সত্যই কি অনাবিল অধ্যাত্মবাদী ও ভাববাদী দর্শন?
————–
২২. যথা… “the fundamental characteristic of Indian thought was an idealistic one” : G. Tucci PFIPC-1925, 35.
২৩. Philosophy for the Future দ্রষ্টব্য।
২৪. H. K. Wells – Pragmatism of Imperialism ইত্যাদি
০৬. কাদের ধ্যানধারণা?
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে দর্শন-বিষয়ে একটি দু’খণ্ডের বই প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেশ-বিদেশের নানা দার্শনিক মতবাদ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ভূমিকা লিখেছেন স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী মাননীয় মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। এই ভূমিকায় তিনি ঘোষণা করেছেন, ভারতীয় চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য হলো বহির্জগতের চেয়ে মানুষের অধ্যাত্মজগতের প্রতিই অনেক বেশি মনোযোগ দেওয়া।
The characteristic of Indian thought is that it has paid greater attention to the inner world of man than to the outer world.(২৫)
ভারতবর্ষে যে বস্তুবাদী চিন্তাধারার কোনো রকম পরিচয়ই ছিলো না এ-কথা অবশ্য ও-বইতে সরাসরি বলা হয় নি। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন বলে একটা কিছু ছিলো বই কি। এমন কি আলোচ্য গ্রন্থে লোকায়ত দর্শনের জন্যে ১০৭৯ পাতার মধ্যে রীতিমতো ৬ পাতা জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবু প্রশ্ন ওঠে, এই লোকায়ত দর্শনের মর্যাদাটা নিয়ে। আমাদের দেশে সত্যের সন্ধানে মানুষের যে-বিচিত্র অভিযান তার মধ্যে লোকায়ত-দর্শনের তাৎপর্য ঠিক কতোটুকু? এ-দর্শন কাদের দর্শন ছিলো?