মহামহোপাধ্যায়ের কাছে কিন্তু এ-জাতীয় কোনো প্রশ্ন ওঠবার অবকাশ ছিলো না। তার কারণ তিনি ধরেই নিয়েছেন, কাম বা মৈথুনকে আজকের দিনে আমরা যে-চোখে দেখি প্রাচীনেরাও ঠিক সেই চোখেই দেখতেন এবং আজকের দিনে আমরা যৌন-আচরণের উদ্দেশ্য বলতে যা বুঝি প্রাচীনেরাও ঠিক তাই বুঝতেন। ফলে কামবিষয়ে অত্যধিক উৎসাহ হয় লাম্পট্য, না হয়তো নিছক ভোগাসক্তি,—খুব বেশি সমীহ করে বললে বড়ো জোর বলা যায় কামবিজ্ঞানের ভিত্তি-স্থাপনা। বস্তুত, কাপালিকদের সম্বন্ধে—তথা, সমস্ত রকম বামাচারী সম্প্রদায় সম্বন্ধেই,—আধুনিক কালে যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ তার মূলে প্রধানতই হলো এদের কামবাহুল্য।
আর ঠিক ওই কথাটাই ভুল। কেননা, প্রাচীনেরা কাম ও মৈথুনকে যে-চোখে দেখেছেন, এই ক্রিয়ার যে-উদ্দেশ্য কল্পনা করেছেন, তার সঙ্গে আমাদের আজকালকার ধ্যানধারণার মিল হয় না। তার কারণ খুব সহজ : প্রাচীনেরা ছিলেন প্রাচীন, আধুনিক নন। তাই আধুনিক ধ্যানধারণাও তাঁদের মধ্যে থাকবার কথা নয়।
ভারতবর্ষের প্রাচীন পুঁথিপত্রেই এ-কথার রাশি রাশি প্রমাণ আছে। যেহেতু পরের যুগে আস্তিকেরা, অর্থাৎ বেদপন্থীরা, নাস্তিকদের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ বেদনিন্দুকদের বিরুদ্ধে, বিদ্বেষ প্রচার করবার জন্যে এই কামবাহুল্যের নজিরটাকেই অতো বড়ো করে দেখিয়েছিলেন সেইহেতুই এখানে এ-বিষয়ে বৈদিক সাহিত্যের সাক্ষ্যটুকুই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হবে। বলাই বাহুল্য, বৈদিক সাহিত্যে ভালো কি মন্দ, সুনীতিপরায়ন কি দুর্নীতিপরায়ণ—এই জাতীয় প্রশ্ন তোলা আমাদের যুক্তির পক্ষে অবান্তর। আমরা শুধু এইটুকুই দেখাতে চাই, যৌনব্যবহার সম্বন্ধে আধুনিক কালের ধারণা দিয়ে প্রাচীন কালের ধারণাকে বোঝবার কোনো উপায় নেই, এবং এ-বিষয়ে প্রাচীনকালের ধ্যানধারণাগুলির চিহ্ন শুধুই যে বেদনিন্দুক ও বৈদিক-ঐতিহ্য-নিন্দিত সম্প্রদায়গুলির মধ্যে টিকে আছে তাই নয়, এমনকি বৈদিকসাহিত্যের মধ্যেই তার অজস্র নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। বস্তুত, বামাচারের প্রকৃত তাৎপর্য বোঝবার পক্ষে বৈদিক সাহিত্যের এই নিদর্শনগুলির গুরুত্বই যেন বেশি : বেদ-ব্রাহ্মণ-উপনিষদে যে-কথা লেখা আছে তারই সাহায্যে কাপালিকাদির মধ্যে প্রচলিত ব্যবহারের অলিখিত তাৎপর্য অনুমান করা সম্ভব হতে পারে।
———————
১৭. আনন্দগিরি : শঙ্করবিজয় ।। সপ্তদশ প্রকরণ, পৃ. ১১৫।।
১৮. অর্থশাস্ত্র (রাধাগোবিন্দ বসাক) ১:৮।
১৯. H. P. Shastri op. cit. 6.
০৫. বৈদিক সাহিত্যে বামাচার
…all understanding of primitive conditions remains impossible so long as we regard them through brothel spectacles(২১) : Engels
অর্থাৎ গণিকালয়ের ঠুলি পরে আদিম অবস্থায় তাৎপর্য বোঝা অসম্ভব।
আধুনিক যুগের রুচিবোধের কাছে বামাচার যে কী সাংঘাতিক বিদ্বেষ-বিতৃষ্ণার উদ্রেক করে তার নিদর্শন হিসেবে রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের একটি মন্তব্য উদ্বৃত করা যায়। গুহ্যসমাজ বা তথাগত গুহ্যক নামে একটি বৌদ্ধ বামাচারী পুঁথি সম্বন্ধে তিনি বলছেন, এই পুঁথিতে এমন সব মতবাদ ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং এমন সব ক্রিয়াকর্মের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে মানুষের জঘন্যতম প্রবৃত্তিও এর চেয়ে ঘৃণিত ও ভয়াবহ কিছুই কল্পনা করতে পারে না এবং তার পাশে গত শতাব্দীর বিলিতি বটতলা বা হলিওয়েল স্ট্রিটের অশ্লীল সাহিত্যেও একান্ত পবিত্র মনে হবে।
…theories are indulged in, and practices enjoined which are at once the most revolting and horrible that human depravity could think of, and compared to which the words and specimens of Holiwell Street literature of the last century would appear absolutely pure.(২২)
কথাগুলি নিশ্চয়ই মিথ্যে নয়। তবুও কিন্তু এ-জাতীয় মনোভাব নিয়ে অগ্রসর হলে প্রাচীন সাহিত্যের প্রকৃত তাৎপর্য উদ্ধার করা অসম্ভব। তার কারণ, যে-নীতিবোধ ও রুচিবোধের মধ্যে এ-জাতীয় মন্তব্যের উৎস সেটা একান্তই আধুনিক কালের, আধুনিক যুগের অবদান। প্রাচীনেরা ছিলেন প্রাচীন, তাই আমাদের নীতিবোধ বা রুচিবোধের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ছিলো না। তাঁরা যে-সাহিত্য রচনা করে গিয়েছেন তা তাঁদের রুচিবোধের অনুপাতেই। তাই আমরা যদি একালের নীতিবোধ নিয়ে তাঁদের সাহিত্যের দিকে চেয়ে দেখি এবং বিদ্বেষ-বিতৃষ্ণায় একেবারে বিরক্ত হয়ে উঠি তাহলে তাঁদের কথার প্রকৃত তাৎপর্য কিছুতেই খুঁজে পাবো না। তাঁরা ঠিক কী ভেবে এ-জাতীয় কথাবার্তা লিখেছিলেন তা জানতে হবে, এবং সে-কথা জানতে হলে অন্তত সাময়িক ভাবে আমাদের রুচিবোধকে মূলতবী রেখে ভেবে দেখতে হবে তাঁদের উদ্দেশ্যটা কী হওয়া সম্ভব।
বৈদিক সাহিত্যে বামাচারের নিদর্শন নিয়ে আলোচনা তোলবার আগে কথাগুলি বিশেষ করে তুলছি; কেননা, একালের ধ্যানধারণাগুলিকে সম্বল করে এগোলে বৈদিক সাহিত্যে বামাচারের নিদর্শনগুলিকে অত্যন্ত বীভৎস কামবিকার ও কুৎসিৎ লাম্পট্যের নমুনা বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। অথচ বৈদিক ঋষিদের কাছে কথাগুলি ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্দেশ্যমূলক। তাই একালের লাম্পট্য-ব্যবহারটার পটভূমিতে সেকালের ঋষিদের এই সব কথাবার্তার প্রকৃত তাৎপর্য অনুমান করা সমম্ভব।