পূর্বপক্ষ বলবেন, বেদান্তে যে-কর্মের নিন্দা তার নাম যজ্ঞকৰ্ম—তাকে সাধারণভাবে শ্রম বললে অর্থবিকৃতি হবে। কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি, আদিতে এই যজ্ঞই ছিলো অন্নলাভের উপায়; যজ্ঞের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য স্বভাবতই উত্তর-যুগের উদ্ভাবন। তবু দ্রষ্টব্য এই যে, বৈদান্তিক চিন্তার মধ্যে অমন আধ্যাত্মিক প্রলেপ সত্বেও কর্মকে স্বীকার করা সম্ভব হয়নি।
আমাদের মূল যুক্তি এইখানেই সমাপ্ত হতে পারতো। কেননা, মায়াবাদ বা বৈদান্তিক ভাববাদ অত্যন্ত সুপরিচিত এবং আমাদের যুক্তির দিক থেকে তার বিশদ-বর্ণন নিম্প্রয়োজন। আমরা শুধু এটুকুই দেখাবার চেষ্টা করেছি যে, বৈদিক সাহিত্যে সমাজ-বিকাশের প্রাক্-বিভক্ত পর্যায়ের বহু স্মারক পাওয়া যায়। তার থেকে প্রমাণ হয়, অন্যান্য মানবজাতির মতোই বৈদিক মানুষেরাও এককালে সমাজবিকাশের প্রাক্-বিভক্ত পর্যায়েই জীবন-যাপন করতেন। তাদের চিন্তাচেতনাও তখন মূলতই প্রাক্-অধ্যাত্মবাদী। কিন্তু এই সমাজ-সংগঠন ভেঙে যাবার ফলে, কালক্রমে, তাদের কাছে কর্ম নিন্দিত হয় এবং তারই ফলে তাদের চেতনায় আবির্ভাব হয় ভাববাদের—ঋগ্বেদের মায়ার গৌরবের ধ্বংসস্তুপের উপর গড়ে ওঠে বৈদান্তিক মায়াবাদ।
কিন্তু এইখানেই আলোচনার শেষ না করে আমরা মায়া-প্রসঙ্গে আর একটি চিত্তাকর্ষক বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই।
ঋগ্বেদে মায়া অবশ্যই বরুণাদি দেবতাদের craft বা কৌশল হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু শুধু দেবতাদেরই নয়, অসুরদেরও। বস্তুত ঋগ্বেদে মায়া যে প্রধানতই অসুর-শক্তি-বোধক ছিলো তা অনুমান করবার যথেষ্ট কারণ আছে; কেননা, ‘অসুরস্য মায়য়া’ বা ওই জাতীয় কথা ঋগ্বেদে বিরল নয়।
চিত্রেভিরভ্রৈরুপ তিষ্ঠথো রবং দ্যাং বৰ্ষয়থো অসুরস্য মায়য়া।
অর্থাৎ,—বিচিত্র মেঘসমূহের দ্বারা তোমরা (মিত্রাবরুণ) সরবে স্বৰ্গকে বর্ষণ করিতে থাক অসুরের মায়ার সাহায্যে।। ঋগ্বেদ : ৫.৬৩.৩ ॥
তাহলে দেবতাদের এই মায়া আসুরী বৈশিষ্ট্য বলেই পরিগণিত হতে পারে। কালক্রমে বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকদের কাছে মায়া নিন্দিত হয়েছিলো। কিন্তু সম্ভবত অসুর বলে বর্ণিত মানুষগুলির মন থেকে মায়ার মহিমা এ-ভাবে মুছে যায়নি। আর হয়তে সেই কারণেই তাদের চেতনাও প্রাক্-আধ্যাত্মবাণী— এবং সেই অর্থে লোকায়তিকই—হয়ে থেকেছিলো। আমরা ইতিপূর্বে ঋগ্বেদ থেকেই অসুরদের লোকায়তিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছি : “হে ইন্দ্র, যাহারা নিজেদের মুখে অন্নহবি প্রদান করিত তুমি মায়াসমূহের দ্বারা সেই মায়াবীদিগকে পরাজিত করিয়াছিলে।” আমরা আরো দেখেছি, তন্ত্র ও সাংখ্যকে অসুরমত বলেই গ্রহণ করবার সম্ভাবনাও সংকীর্ণ নয়। এই কারণেই কি সাংখ্যে প্রকৃতি বা অচেতন-জগৎকারণের নামান্তর হিসেবে মায়ার গৌরব অক্ষুণ্ণ থেকেছে! বেদান্তমতেও মায়াই জগৎকারণ; কিন্তু মায়া মানে মিথ্যা, তাই জগৎ মিথ্যা। অপরপক্ষে, সাংখ্যমতে এই মায়াই চূড়ান্ত সত্য। আর হয়তো তাই-ই প্রাক্-অধ্যাত্মবাদী বৈদিক চেতনার ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে বৈদান্তিক বাদরায়ণ ওই সাংখ্যমতকেই প্রধানতম প্রতিপক্ষ হিসেবে খণ্ডন করবার চেষ্টা করেছেন।
——————–
৮৮. A. B. Keith op. cit. 1:83.
৮৯. A. A. Macdonell VM 24.
৯০. Ibid.
(সমাপ্ত)