হোতা দেবো অমর্ত্যঃ পুরস্তাদেতি মায়য়া। বিদথানি প্রচোদয়ন্।।
অর্থাৎ,—মৃত্যুহীন হোতা দেবতা (অগ্নি) সভাসমূহকে অনুপ্রেরিত করিবার জন্য সম্মুখে মায়াযুক্ত হইয়া আসিতেছেন। ঋগ্বেদ : ৩.২৭.৭ ।।
কিন্তু ঋগ্বেদের দশম মণ্ডল রচিত হবার সময় ওই বৈদিক সভায় ভাঙন ধরেছিলো বলেই অনুমান হয়; কেননা তা না হলে বৈদিক কবি অতীতের স্মৃতিকে উদ্বুদ্ধ করে সমিতিতে সমান হবার জন্য অমন ব্যাকুল আবেদন (পৃ. ৫৬৮) ঘোষণা করবেন কেন? এবং এই দশম মণ্ডলেই দেখা যায় মায়া যেন বন্ধ্যাত্ব প্রাপ্ত হচ্ছে—যে-মায়া দেবতাদের প্রধানতম কৌশল ছিলো, যে-মায়াদ্বারা দেবতারা সভাসমিতিকে অনুপ্রেরিত করতেন, সেই মায়াই নিষ্ফল ও বন্ধ্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
উত ত্বং সখ্যে স্থিরপীতমাহুর্নৈনং হিন্বন্ত্যপি বাজিনেষু।
অধেন্বা চরতি মায়য়ৈষ বাচং শুশ্রুবা অফলামপুষ্পাম্।
অর্থাৎ, (হে ব্ৰহ্মণস্পতি) তুমি এই সখ্যে স্থির নিশ্চয় হইয়াছ; কেহ আর সংগ্রামে ইহার অনুগমন করে না। এই ব্যক্তি ধেনুবিহীন হইয়া মায়ার দ্বারা বিচরণ করে, সে নিস্ফল পুষ্পবিহীন বাক্য শ্রবণ করে। ঋগ্বেদ : ১০.৭১.৫ ৷
ভাষ্যে সায়ণ বলছেন,
যথা বন্ধ্যা পীনা গৌঃ কিং দ্রোণমাত্ৰং ক্ষীরং দোগ্ধীতি মায়ামূৎপাদয়ন্তী চরতি যথা বন্ধ্যো বৃক্ষোহকালে পল্লবাদিযুক্তঃ সন্ পুষ্প্যতি ফলতীতি ভ্রান্তিমূৎপাদয়ংস্তিষ্ঠতি তথা…
অর্থাৎ,–যেমন কোনো বন্ধ্যা স্থূল গাভী,–হয়তো অল্প দুগ্ধ দান করে,–এইরূপ ভ্রম উৎপন্ন করিয়া বিচরণ করে, যেরূপ নিফল বৃক্ষ অকালে পল্লবাদি যুক্ত হইয়া—ইহা হয়তো পুষ্প ও ফল ধারণ করে, এইরূপ ভ্রান্তি উৎপাদন করিয়া থাকে, সেইরূপ।
আরো পরে—বেদান্তে—এই মায়া বলতে শুধুমাত্র, মিথ্যা, অনৃত ও ভ্রান্তিই বুঝিয়েছে। তারই নাম হয়েছে মায়াবাদ এবং এই মায়াবাদই ভারতীয় দর্শনে ভাববাদের প্রধানতম ভিত্তিস্তম্ভ।
ঋগ্বেদে মায়ার কথা আছে; কিন্তু বৈদান্তিক অর্থে মায়াবাদ নেই—বড়ো জোর ঋগ্বেদের অর্বাচীন অংশে মায়াবাদের আভাস দেখা দিয়েছে। মায়াবাদের পরিবর্তে ঋগ্বেদে দেখা যায় দেবতাদের কৌশল ও প্রজ্ঞারই নাম হলো মায়া। ঋতের পালক ঋতজ্ঞ সখা ও নিত্যবন্ধু বরুণের প্রধানতম শক্তির নাম মায়া; তারই সাহায্যে তিনি যজ্ঞসমূহকে রক্ষা করেন, চন্দ্রের ন্যায় নিজপ্রভা বহুলভাবে বিস্তারিত করেন; মায়ার সাহায্যেই তিনি অন্তরীক্ষে অবস্থান করে সূর্যকে পৃথিবী থেকে পৃথক করেন এবং এই মায়াই তার আয়ুধের মতো। ইন্দ্রেরও প্রধানতম কৌশল বলতে এই মায়াই; মায়ার সাহায্যেই তিনি গাভীগুলি নির্মাণ করেছিলেন, মায়ার দ্বারাই তিনি মায়াবী শুষ্ণকে পরাজিত করেন, মায়াযুক্ত মৃগকে বধ করেন এবং এমনকি ধনদাতাকে পর্যুদস্ত করেন। যে-পার্থিব ধন এবং নিরাপত্তার কামনা সমগ্র ঋগ্বেদের মূলসূত্র তা লাভ করবার কৌশলও ওই মায়াই। মায়ার দ্বারাই হোতো ব্রতকে উর্ধ্বে ধারণ করেন, অগ্নি ভুবনসমূহকে পবিত্র করেন এবং সভাগুলিকে অনুপ্রাণিত করেন। ইত্যাদি। ইত্যাদি।
এই হলো ঋগ্বেদে মায়ার কথা। এ-কথা আর যাই হোক, বেদান্তের মায়াবাদ নয়। বস্তুত, সামগ্রিকভাবে ঋগ্বেদের মূল স্বরটিই মায়াবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। পৃথিবীকে বা পার্থিব বস্তুকে অলীক বা মিথ্যা মনে করে কোনো এক চিন্ময় সত্তার কল্পনায় বিভোর হবার পরিচয় ঋগ্বেদে নেই। তার বদলে মেয়েলি ব্রতের ছড়াগুলির মতোই—বা আফ্রিকার দিন্ক ট্রাইবদের কবিতার মতোই—সহজ সরলভাবে একান্ত পার্থিব সম্পদের কামনা ব্যক্ত করাই বৈদিক মন্ত্রগুলির মূল কথা। তাই বৈদিক চিন্তাচেতনাকে যদি একান্তই কোনো দার্শনিক সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব হয় তাহলে তাকে বস্তুবাদ বলতে হবে—সে-বস্তুবাদ যতো অস্ফূট, যতো অচেতন, যতো আদিমই হোক না কেন। কেননা এখানে পরকাল বা পরলোকের কথার কোনো পরিচয় নেই, পরিচয় নেই চিন্ময় জগৎকারণের কোনো কল্পনার। তার বদলে শুধু কামনা— একান্ত পার্থিব সহজ সরল কামনা।
এবং পার্থিব কামনা-পরিপূরক কৌশল হিসেবেই ঋগ্বেদ মায়ার মহিমায় মুখর। অতএব, ঋগ্বেদে মায়ার যে কথা তাও ওই অস্ফূট ও আদিম বস্তুবাদী চেতনারই অঙ্গীভূত।
কিন্তু বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকেরাই—বৈদান্তিকেরাই—ঋগ্বেদের এই প্রাক-অধ্যাত্মবাদী ও প্রাক্-ভাববাদী চেতনার ধ্বংসস্তুপের উপর ভাববাদের প্রাসাদ গড়ে তুলেছিলেন এবং সে-ভাববাদের প্রধানতম ভিত্তি বলতে মায়াবাদই। এবং এই মায়াবাদ প্রসঙ্গে মায়া শব্দ আর আদিম সমাজের craft বা কৌশল নয়; তার বদলে বন্ধ্যা-ধারণা, মিথ্যা, মরীচিকা। আমরা দেখাতে চাইছি, মায়া শব্দের এই অর্থ-বিপর্যয়টির অন্তরালেই ভাববাদের জন্মকাহিনী প্রচ্ছন্ন থাকা অসম্ভব নয়। অতএব, ভাববাদের উৎস-সন্ধানে অগ্রসর হতে হলে মায়া শব্দের অর্থ-বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধান করা যেতে পারে।
বেদ আর বেদান্তের মধ্যে একটা যুগান্তরের ইতিহাস রয়েছে—প্রাচীন প্রাক্-বিভক্ত পর্যায় থেকে প্রকট শ্রেণীবিভক্ত পর্যায়ে এসে পড়ার ইতিহাস। বেদের পর ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণের পর উপনিষদ বা বেদান্ত। ঋগ্বেদের যুগের শেষেই—এবং ব্রাহ্মণের যুগে আরো স্পষ্টভাবে—প্রাক্-বিভক্ত প্রাচীন সাম্যসমাজ ভেঙে পড়বার ছবি দেখতে পাওয়া যায়। প্রাক্-বিভক্ত সমাজে সকলেই সমানভাবে যৌথশ্রমে অংশ গ্রহণ করে। তাই শ্রম বা কৌশল বা craft সে-পর্যায়ে নিন্দিত বা হেয় বলে পরিগণিত নয়। কিন্তু সমাজের এই যৌথ সংগঠন ভেঙে যতোই শ্রেণীবিভাগ ফুটে উঠতে থাকে—সমাজের শাসক মহল শ্রমের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব থেকে যতোই মুক্ত হয়—ততোই এই শ্রম হেয় বা হীনবৃত্তি বলে পরিগণিত হতে থাকে। কেননা, নবপরিস্থিতিতে যে-শ্রেণীর মানুষের উপর এই শ্রমের দায়িত্ব সামাজিকভাবে তারা মর্যাদাহীন হয়ে দাঁড়ায়। এই নবপরিস্থিতিতে কী ভাবে মানব-চেতনায় ভাববাদের আবির্ভাব হয় তার সাধারণ যুক্তি আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি (পৃ.৮২ এবং ৫৪৩)। ভারতীয় দর্শনের বিশিষ্ট ক্ষেত্রে ভাববাদের আবির্ভাব প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে, যে-উপনিষদ বা বেদান্তে এই ভাববাদের আবির্ভাব তার নাম জ্ঞানকাণ্ড। বেদান্তে শুধু যে জ্ঞান ও কর্মের মধ্যে বিরোধ কল্পিত হয়েছে তাই নয়, কর্ম নিন্দিত হয়েছে এবং একমাত্র জ্ঞানেরই গৌরব স্বীকৃত হয়েছে। অতএব যে-মায়া বা craft এককালে বৈদিক মানুষদের মধ্যেই পরম গৌরবময় শক্তি বলে পরিগণিত ছিলো কালক্রমে তাই হেয়, নিন্দিত ও মিথ্যাবোধক হয়ে দাঁড়ালো।