এই মায়াই মিত্রাবরুণের আয়ুধের মতো।
মায়া বাং মিত্রাবক্ষণা দিবি শ্রিতা সূর্যো জ্যোতিশ্চরতি চিত্রমায়ুধম্।
অর্থাৎ, —হে মিত্রাবরুণ, তোমাদের মায়া স্বৰ্গকে আশ্রয় করিয়াছে এবং সূর্যরূপে বিচিত্র আয়ুধ হইয়া ইহা পরিভ্রমণ করিতেছে।। ঋগ্বেদ : ৫.৬৩.৪।।
কিন্তু শুধু মিত্রাবরণই নন; অন্যান্য দেবতাদের কর্মকৌশলকেও ঋগ্বেদে মায়া বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।
ইন্দ্র যে গাভী নির্মাণ করেছিলেন তাও এই মায়ার দ্বারাই।
তদিন্ন্বস্য বৃষভস্য ধেনোরা নামভিৰ্মমিরে সক্ম্যং গোঃ।
অন্যদন্যদসূৰ্যং বসানা নি মায়িনো মমিরে রূপমস্মিন্।
অর্থাৎ, –অভিলাষ-পূরণকারীর হবনীয় গাভীকে মায়াযুক্ত ইনি (ইন্দ্র) ‘ধেনু’ এই নামের দ্বারা নির্মাণ করিয়াছিলেন; অন্যান্য অসূর্য-শক্তিকে পরাজিত করিয়া ইনি ইহাদিগকে (প্রকৃত) রূপে (মায়াদ্বারা) নির্মিত করিয়াছিলেন।। ঋগ্বেদ : ৩.৩৮.৭ ।।
এমনকি ইন্দ্রের যে-রণকৌশল তারও নাম মায়া। মায়ার দ্বারাই তিনি মায়াবী শুষ্ণকে পরাজিত করেন।
মায়াভিরিন্দ্র মায়িনং ত্বং শুষ্ণমবাতিরঃ।
অর্থাৎ, —মায়াসমূহদ্বারা ইন্দ্র, হে মায়াবী শুষ্ণ, তোমাকে পরাজিত করিয়াছিলেন।। ঋগ্বেদ : ১.১১.৭ ।।
এবং এই মায়ার দ্বারাই তিনি মায়াযুক্ত মৃগকে বধ করেছিলেন।
ত্যং মায়িনং মৃগং তমু ত্বং মায়য়াবধীঃ
অর্থাৎ,—তুমি (ইন্দ্র) মায়াদ্বারা সেই মায়াযুক্ত মৃগকে বধ করিয়াছিলে।। ঋগ্বেদ : ১.৮০.৭ ।।
ইন্দ্র যে ধনদাতাকে পর্যুদস্ত করেছিলেন তাও এই মায়ার দ্বারাই, মায়ার সাহায্যেই।
মায়াভিধনদাং পর্যভূবন্… … … …
… … … … নির্জোতিষা তমসো গা অদুক্ষৎ ॥
অর্থাৎ, —(ইন্দ্ৰ) ধনদাতাকে মায়াসমূহ দ্বারা পর্যুদস্ত করিয়াছিলেন এবং আলোকের দ্বারা অন্ধকার হইতে গরুগুলিকে দোহন করিয়াছিলেন।। ঋগ্বেদ : ১.৩৩.১০ ॥
যে-পার্থিব ধনের এবং নিরাপত্তার কামনাকেই সামগ্রিকভাবে ঋগ্বেদের মূলসূত্র হিসেবে দেখতে পাওয়া যায়, তা লাভ করবার কৌশলকেও মায়া বলা হয়েছে।
রেবদ্বয়ো দধাথে রেবদাশাথে নরা মায়াভিরিতঊতি মাহিনম্।
অর্থাৎ, —(হে মিত্রাবরুণ), তোমরা দুইজন ধন এবং অন্ন ধারণ কর; তোমরা নেতা, আমাদিগকে মায়াসমূহ অবলম্বনে ধন (ও অন্ন) দান কর, তোমরা মহৎ।। ঋগ্বেদ : ১.১৫১.৯ ।।
এবং মায়ার সাহায্যেই মিত্রাবরুণ অমোঘ নিয়মের ধারক হন।
যা বো মায়া অভিদ্রুহে যজত্ৰাঃ পাশা আদিত্যা রিপবে বিচৃত্তাঃ।
অর্থাৎ, —হে যজনীয়গণ (আদিত্যগণ), তোমাদের মায়া এবং পাশসমূহ বিদ্রোহী শক্রর উদ্দেশ্যে প্রসারিত ॥ ঋগ্বেদ : ২.২৭.১৬ ।।
এই মায়ার দ্বারাই ইন্দ্র স্বৰ্গকে পতন থেকে স্তব্ধ করেছিলেন।
অস্তভ্নাৎ মায়য়া দ্যামবস্রসঃ।
অর্থাৎ, —(ইন্দ্র) মায়াদ্বারা স্বৰ্গকে পতন হইতে স্তব্ধ করিয়াছিলেন।। ঋগ্বেদ : ২.১৭.৫ ।।
আমরা ইতিপূর্বে দেখাবার চেষ্টা করেছি যে, আদিতে ওই পার্থিব ধনলাভের পদ্ধতিকেই যজ্ঞ বলা হতো—এমন কথা অনুমান করবার সুযোগ আছে। এবং ঋগ্বেদে ধন-লাভ-কৌশলের নামান্তর যদি মায়াই হয় তাহলে যজ্ঞের সঙ্গেও মায়ার সম্পর্ক দেখতে পাওয়া উচিত। বস্তুত ঋগ্বেদেই এ-সম্পর্কের ইংগিত খুঁজে পাওয়া যায়।
মায়ার দ্বারাই হোতা ব্ৰতকে উর্ধ্বে ধারণ করেন।
এতি প্র হোতা ব্রতমস্য মায়য়োর্ধ্বাং দধাননঃ
অর্থাৎ, —হোতা ব্রতকে মায়ার দ্বারা উর্ধ্বে ধারণ করিয়া এইদিকে আসিতেছে। ঋগ্বেদ : ১.১৪৪.১ ।।
মায়ার দ্বারাই অগ্নি ভুবনসমূহকে পবিত্র করেন।
স বহ্নিঃ পুত্রঃ পিত্রোঃ পবিত্রবান্ পুনাতি ধীরো ভূবনানি মায়য়া।
ধেনুং চ পৃশ্নিং বৃষভং সুরেতসং বিশ্বাহা শুক্রং পয়ো অস্য দুক্ষত।।
অর্থাৎ,–পিতামাতার পুত্র সেই বহ্নি (অগ্নি) পবিত্র, ধীর; তিনি মায়ার দ্বারা ভুবনসমূহকে পবিত্র করেন; তিনি চিরকাল ধরিয়া শুক্লবৰ্ণ গাভী এবং শোভন রেতঃযুক্ত বৃষভ হইতে শুক্র এবং দুগ্ধ দোহন করেন।। ঋগ্বেদ : ১.১৬৩.৩ ।৷
এবং মায়াবীদের মায়া অগ্নির মধ্যেও সংস্থাপিত হয়েছিলো।
যাশ্চ মায়া মায়িনাং বিশ্বমিন্ব ত্বে পূর্বীঃ সংদধুঃ পৃষ্টবন্ধো।
অর্থাৎ, —মায়াবীদের যে-সমস্ত মায়া, হে জিজ্ঞাসুদিগের বন্ধু, বিশ্বম্ভর (অগ্নি), তাহা পূর্বেই তোমাতে সংস্থাপিত হইয়াছে।। ঋগ্বেদ : ৩.২০.৩ ।।
মায়া প্রসঙ্গে ঋগ্বেদের আরো অনেক মন্ত্র উদ্ধৃত করা যায়। কিন্তু আমাদের মূল যুক্তির পক্ষে তার প্রয়োজন নেই। কেননা, আমাদের যুক্তির দিক থেকে শুধু এটুকু প্রতিপন্ন করাই প্রয়োজন যে, বৈদিক মানুষের এককালে মায়া বলতে কর্মকৌশলই বুঝতেন এবং তখন তার প্রাক্-বিভক্ত পর্যায়ে জীবনযাপন করতেন বলেই তাদের ধ্যানধারণায় শ্রম বা কর্মকৌশল নিন্দিত হয়নি। তাই ঋগ্বেদে মায়া তো নিন্দিত নয়ই; বরং এই মায়ার গৌরব-বর্ণনাতেই ঋগ্বেদ যেন ভরপুর। মায়ার গৌরবের সঙ্গে প্রাক্-বিভক্ত পর্যায়ের সম্পর্ক কী রকম ছিলো এবং সেই প্রাক্-বিভক্ত সমাজ-সংগঠন ভেঙে যাবার পর ঋগ্বেদেরই পরের অংশে মায়ার গৌরব কী ভাবে ক্ষুণ্ণ হতে শুরু করেছে এখানে তারই সামান্য উদাহরণ উদ্ধৃত করবো।
আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি, বৈদিক সমাজের প্রাক্-বিভক্ত পর্যায়ের একটি প্রধান পরিচয় হলো সভা। ঋগ্বেদে দেখি, অগ্নি মায়ার দ্বারাই এই সভাসমূহকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।