অস্ত মে দ্যাবাপৃথিবী ঋতায়তো ভূতমবিত্ৰী বচসঃ সিযাসতঃ।
যযোরায়ুঃ প্ৰতরং তে ইদং পুর উপস্তুতে বসুযুর্বাং মহো দধে।।
অর্থাৎ, —হে রক্ষাকত্রীত,দ্যাবাপৃথিবী, ঋতের কামনা করিয়া বাক্যের দ্বারা তোমাদিগকে তুষ্ট করিতে ইচ্ছুক হইয়াছিল; তোমরা অন্ন প্রকৃষ্টভাবে উৎপন্ন কর, ধনকামনা করিয়া তোমাদিগের স্তুতি করি।। ঋগ্বেদ : ২. ৩২.১।।
এই ঋতই হলো প্রাচীন প্রাক্-বিভক্ত সমাজের সেই অখণ্ড নীতিবোধ, এঙ্গেলস্ যাকে বলেছেন, the simple moral grandeur of the ancient gentile society । আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি (পৃ.২৩৩), মহাবস্তু অবদান প্রভৃতি প্রাচীন গ্রন্থ থেকেও এই নীতিবোধটির স্মৃতি সম্পূর্ণভাবে মুছে যায়নি : “সুখনিবাসে থাকিয়া তাঁহারা প্রীতিভক্ষণ করিয়া জীবনযাত্রা নির্বাহ করেন। তাঁহারা যাহা করেন সকলই ধর্ম।” এ-নীতিবোধ স্বাভাবিক এবং সহজাত, মানবচেতনার অপরিহার্য অঙ্গ—তাই প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই অমোঘ, প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই স্বাভাবিক। কিংবা, যা একই কথা, প্রকৃতির চেতনা এবং এই নৈতিক নিয়মের চেতনা তখনো এক অখণ্ড সামগ্রিক চেতনারই অঙ্গীভূত।
বৈদিক ঋষিরা তারই নাম দিয়েছিলেন, ঋত।
আর অতীতের সেই বরুণ—সেই প্রিয় ও নিত্যবন্ধু বরুণ—তাঁর নৈতিক ঐশ্বর্য বলতেও এই ঋত, এই আদিম অখণ্ড নীতিবোধ। তিনি ঋতের পালক, ঋতের বর্ধক। তিনি শুধু দেন–মানুষের গোশালাগুলি ঘৃতসিক্ত করেন, বাসস্থানগুলি মধুসিক্ত করেন (৩.৬২.১৬); তাঁর জলযুক্ত বৃষ্টি মানুষদের মধ্যে সঞ্চরণ করে (৮.২৫.৬)।
আর উত্তর সাহিত্যে দেখি, এই বরুণই পরিণত হয়েছেন এক বিকট বিভীষিকায় : পাওনা-আদায়ের জন্যে তাঁর হানা দেওয়ার যেন বিরাম নেই, স্নানের পর মানুষ পিছন ফিরে তাকাতে ভয় পাচ্ছে—বরুণের আতঙ্কে আতঙ্কিত।
বরুণের এই অদ্ভূত রূপান্তর ঘটলো কী করে?
লোভে লালসায় মানবসমাজ তখন বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তখন ক্ষুধাপীড়িত পিতা শত-গাভীর আশায় পুত্রকে বিক্রয় করছে, শত-গাভীর প্রলোভনে পুত্রকে যুপে বদ্ধ করতে অগ্রসর হচ্ছে, শত-গাভীর লালসায় শানিত অসি হস্তে অগ্রসর হচ্ছে এই পুত্রকেই বধ করবার জন্য।
যুপে-বদ্ধ পুত্র ওই অতীত-বরুণের স্মৃতিই উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, কামনা জানিয়েছিলেন,
নিঋতি থেকে আমাদের দূরে রাখো
আমাদের কৃতপাপ থেকে আমাদের মুক্ত করো।
———–
৮৫. E. Engels OFPPS 163. ,258 .
৮৬. Ibid 258.
৮৭. Ibid. 163.
১৫. মায়া : ভাববাদের আবির্ভাব
অতীতের সেই বরুণ শুধুই যে ঋতযুক্ত ও ঋতজ্ঞ তাই নন, মায়াবীও।
ধর্মণা মিত্রাবরুণা বিপচ্চিতা ব্রতা রক্ষেথে অসূরস্য মায়য়া।
ঋতেন বিশ্বং ভূবনং বি রাজথঃ সূর্যমা ধত্থো দিবি চিত্র্যং রথম্॥
অর্থাৎ, —হে প্রাজ্ঞ মিত্রাবরুণ, তোমরা ধর্মদ্বারা ও অসুরের মায়াদ্বারা যজ্ঞসমূহ রক্ষা কর, ঋতদ্বারা এই বিশ্বভুবনকে দীপ্যমান কর, সূর্যকে তাহার বিচিত্র রথসহ ধারণ করিয়া থাক।। ঋগ্বেদ : ৫.৬৩.৭ ।৷
ঋতস্য বুধ্ন উষসামিষণ্যম্বৃষা মহী রোদসী আ বিবেশ।
মহী মিত্রস্য বরুণস্য মায়া চন্দ্রেব ভানুং বি দধে পুরুত্রা।।
অর্থাৎ, —উষাগুলিকে প্রেরণ করিতে ইচ্ছুক হইয়া ঋতের মূল বৃষ্টির সাহায্যে স্বর্গ ও পৃথিবীর মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল; মিত্র ও বরুণের মহতী মায়া চন্দ্রের ন্যায় নিজপ্রভা বহুলভাবে প্রসারিত করিয়াছিল।। ঋগ্বেদ : ৩.৬১.৭ ।।
স্বভাবত অধ্যাপক ম্যাকডোন্যাল মন্তব্য(৮৯) করছেন,
The divine dominion of Mitra and Varuna is often referred to with the word Maya.
কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, উত্তরকালে, বিশেষত বেদান্ত-দর্শনের প্রভাবে, মায়া বলতে আমরা যা বুঝতে শিখেছি ঋগ্বেদে মায়ার অর্থ মোটেই তা নয়। ঋগ্বেদের মায়া প্রসঙ্গে অধ্যাপক ম্যাকডোন্যাল(৯০) মন্তব্য করছেন,
It has an almost exact parallel in the English word ‘craft’, which in its old significance meant ‘occult power, magic’, then ‘skilfulness, art on the one hand and ‘deceitful skill, wile’ on the other. The good sense of Maya, like that of asura (which might be rendered by ‘mysterious being’) is mainly connected with Varuna and Mitra, while its bad sense is reserved for demons. *
আমরা আগেই দেখেছি, প্রাচীন-সমাজে উৎপাদন-কৌশল অনুন্নত বলেই শ্রমের অপরিহার্য অঙ্গ ছিলো জাদুশক্তিতে বিশ্বাস। ঋগ্বেদের ‘মায়া’ শব্দটির মধ্যে আমরা হয়তো তারই আভাস পাই; মায়া হলো কৌশল, প্রজ্ঞা, ক্ষমতা এবং সেইসঙ্গে জাদুশক্তিও। এবং প্রাক্-বিভক্ত পর্যায়ে কর্মকৌশলের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়নি বলেই এই মায়াই তখন দেবতাদেরও পরম গৌরবময় শক্তি হিসেবেই কীর্তিত হয়েছে।
এই মায়ার দ্বারাই বরুণ সূর্যকে পৃথিবী থেকে পৃথক করেছিলেন।
ইমামু স্বাসুরস্য শ্রুতস্য মহীং মায়াং বরুবস্য প্র বোচম্।
মানেনেব তস্থিবা অন্তরিক্ষে বি যো মমে পৃথিবীং সূর্যেন।।
অর্থাৎ, —অসুরের হননোপযোগী এই মহৎ বিখ্যাত মায়ার কথা বলিতেছি—যাহার দ্বারা বরুণ অন্তরীক্ষে থাকিয়া যেন দণ্ডের দ্বারা সূর্যকে ও পৃথিবীকে পৃথক করিয়াছিলেন। ঋগ্বেদ : ৫.৮৫.৫ ॥