ইন্দ্রের পক্ষে এইভাবে বরুণের গৌরবময় স্থান অধিকার করবার পিছনে একটা ঐতিহাসিক কারণও থাকা স্বাভাবিক বা সম্ভব। কেননা, পশুপালন-নির্ভর ট্রাইবের পক্ষে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের দিকে যে-অগ্রগতি, তার একটি প্রধানতম অঙ্গ হলো যুদ্ধের উৎসাহ-বৃদ্ধি। পশুপালন-জীবী ট্রাইবদের পক্ষে শ্রেণীসমাজের দিকে অগ্রসর হওয়া প্রসঙ্গেই এঙ্গেলস্(৮১) বলছেন,
The military commander of the people—rex, basileus, thiudans—became an indispensable and permanent official. The wealth of their neighbours excited the greed of the peoples who began to regard the acquisition of wealth as one of the main purposes in life. They were barbarians: plunder appeared to them easier and even more honourable than productive work War, once waged simply to avenge aggression or as a means of enlarging territory that had become inadequate, was now waged for the sake of plunder alone and became a regular profession.
এঙ্গেলস্ দেখাচ্ছেন, এ-অবস্থায় ধন বলতে প্রধানতই গোসম্পদ। এমনকি, cattle assumed the function of money and served as money already at this stage(৮২)। বৈদিক সমাজে কী ভাবে তা শুরু হয়েছিলো শুনঃশেপের উপাখ্যানেই আমরা তার পরিচয় পেয়েছি : একশত গাভীর বিনিময়ে অজীগর্ত তাঁর পুত্রকে বিক্রয় করলেন। আর এই গাভীর কামনাই যে কীভাবে বৈদিক মানুষদের জীবনে যুদ্ধের উদ্দীপনা যোগাতে শুরু করেছিলো আমরা তারও আভাস পেয়েছি গবিষ্টি বলে শব্দটির মধ্যেই : গবিষ্টি মানে গরু পাবার ইচ্ছা, গবিষ্টি মানেই যুদ্ধ।
আমাদের যুক্তির বর্তমান পর্যায়ে মন্তব্য হলো, বৈদিক মানুষদের জীবনে যতোই লুণ্ঠন ও লোভের প্রভাব বর্ধিত হয়েছে,—যতোই বর্ধিত হয়েছে যুদ্ধের উদ্দীপনা—ততোই তাদের দেবলোকেও ওই যুদ্ধের দেবতা, লুণ্ঠনের দেবতা, বীর ইন্দ্রের গৌরব বেড়ে চলা স্বাভাবিক। এই ইন্দ্রের গৌরবই যদি সামগ্রিকভাবে ঋগ্বেদ-সংহিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকে তাহলে অনুমান করতে হবে পশুপালনমূলক অর্থনীতির বিকাশের ওই পর্যায়টির বৈশিষ্ট্যই সামগ্রিকভাবে ঋগ্বেদ সংহিতার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
কিন্তু অতীতের স্মৃতি হিসেবেই হোক বা বাস্তবিক পক্ষে প্রাচীন রচনার পরিচায়ক হিসেবেই হোক, ঋগ্বেদ সংহিতাতেই এমন একটি দেবতার অতীত গৌরবের আভাস পাওয়া যাচ্ছে যাঁর মহিমার প্রধান কথা ওই লুণ্ঠন-অপহরণমূলক যুদ্ধ নয়—তার বদলে যিনি ছিলেন অন্নের বিভক্ত, অনৃতের হন্তা, ঋতের পালক। তাঁর নাম বরুণ। এবং কালক্রমে, বৈদিক ঋষিরা যতোই যুদ্ধকে মহত্তম বৃত্তি বলে সন্মান করতে শিখেছিলেন ততোই তাদের সাহিত্যে বরুণের মহিমাকে অবদলিত করে ইন্দ্রের মহিমা প্রধান হয়ে উঠেছে।
এভির্ন ইন্দ্রাহভির্দশস্য দুর্মিত্রাসো হি ক্ষিতয়ঃ পবন্তে।
প্রতি যচ্চষ্টে অনৃতমনেনা অব দ্বিতা বরুণো মায়ী নঃ সাৎ।।
অর্থাৎ,–হে ইন্দ্র, দুষ্ট মিত্ররূপী বাধাদানকারী মানবদল আসিতেছে; তাহাদের নিকট হইতে ধন কাড়িয়া লইয়া আমাদিগকে এই পুণ্য দিনে দান কর। মায়াবী বরুণ আমাদিগের মধ্যে যে অনৃত দেখেন তুমি তাহা দ্বিধাবিভক্ত করিয়া অপনোদন কর।। ঋগ্বেদ : ৭.২৮.৪ ।।
এই লোভ, এই লুণ্ঠন, এই যুদ্ধকে বরুণ তখনো অসত্য বা অনৃত হিসেবেই দেখছেন। অর্থাৎ অমোঘ ন্যায়ের পালক বরুণের স্মৃতির সঙ্গে এই লোভ ও লুণ্ঠনের সামঞ্জস্য থাকছে না। তাই লুণ্ঠনের নেতা ইন্দ্রের কাছে কামনা জানানো হচ্ছে, অতীতকালের অমোঘ ন্যায়ের মানদণ্ডে যা আজ অন্যায়, অমৃত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে সেই অমৃতবোধকে দ্বিধাবিভক্ত করো, অপনোদন করো।
বৈদিক মানুষেরা যখন এই কামনা করতে শিখেছেন তখন তারা শ্রেণী সমাজের কতোখানি কাছাকাছি এসে পড়েছেন বেদাবিদেরা তার আলোচনা করবেন। আপাতত আমাদের দ্রষ্টব্য হলো, বৈদিক সমাজের এই পরিবর্তনটির ফলে শুধুই যে অতীত দেবতার স্থানে নতুন দেবতার গৌরব ফুটে উঠছে তাই নয়, অতীতের দেবতার চরিত্রেরও বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছে।
কেননা, মানব-ইতিহাসের অমোঘ নিয়মের সামনে এমনকি বৈদিক দেবতারাও অসহায়ের মতো। তাঁদের চরিত্রের প্রধানতম উপকরণ বলতে এই মরলোকের মানুষদেরই ধ্যানধারণা, আশা-আকাঙ্খা—শেষ পর্যন্ত যার উৎস হলো প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আর মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। অতএব, ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফলে মানুষের মৌলিক অভিজ্ঞতায় পরিবর্তন দেখা দিলে, তাদের ধ্যানধারণা ও আশা-আকাঙ্খায় বিপর্যয় ঘটলে, দেবতার চরিত্রেও বিপর্যয় ঘটা অসম্ভব নয়।
বৈদিক সমাজের বাস্তব পরিস্থিতি যখন এই হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ক্ষুধাপীড়িত পিতা শতগাভীর বিনিময়ে পুত্রকে বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে,— শুধু তাই নয়, আরো শতগাভীর প্রলোভনে পুত্রকে যুপে বদ্ধ করতে এবং আরো শতগাভীর লোভে শানিত অসি হস্তে তাকে বধ করতে অগ্রসর হচ্ছে—তখন? তখন নিশ্চয়ই অনুমান করতে হবে যে, প্রাচীন কালের জ্ঞাতি-সম্পর্কের গুরুত্বকে ধূলিসাৎ করে মানুষে-মানুষে সম্পর্কের চূড়ান্ত নিয়ন্তা হিসেবে দেখা দিয়েছে একটি নতুন শক্তি, তার নাম লোভ, লিপ্সা, লালসা। অতএব, অতীতের সেই বরুণ—সেই সখা, সেই দাতা, সেই প্রিয় ও নিত্যবন্ধু, সেই ঋতের পালক অনৃতের হন্তা—তাঁর পূর্বপরিচয়ও অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে ঐতরেয় ব্রাহ্মণে আমরা দেখছি, অতীত বরুণেরই প্রেত, পাওনা-আদায়ের লোভে অতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।