বরুণের এই নৈতিক গৌরব প্রসঙ্গে অধ্যাপক কীথ্(৭৭), বলছেন,
But more important than these physical attributes of the god are his moral qualities, his control of the order of the world in its ethical aspect no less than in its physical, his connexion with the worshipper as the saviour in time of peril and distress, the freer from sin, the merciful god, as well as the punisher of the sinner.
ঋগ্বেদে বরুণের যে-পরিচয় তার মধ্যে এই নৈতিক গৌরবের দিকটির কথাই আমাদের পক্ষে বিশেষ করে মনে রাখা প্রয়োজন; কেননা, অধ্যাপক কীথ্(৭৮) যেমন বলছেন,
it is essential to note that this side of Varuna’s nature is one which steadily disappears in the later texts…
ঐতরেয়-ব্রাহ্মণের পাওনা-আদায়কারী কাবুলিওয়ালা বরুণটির পরিচয় আমরা ইতিপূর্বেই পেয়েছি; এবং উত্তরযুগের সাহিত্যে বরুণ যে কী বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তার পরিচয় অধ্যাপক কীথ্কে অনুসরণ করেই আমরা একটু পরে আরো স্পষ্টভাবে দেখতে পাবো। এই চারিত্রিক পরিবর্তন যে কতোখানি মৌলিক তা হৃদয়ঙ্গম করবার জন্যে আমাদের পক্ষে ঋগ্বেদ বর্ণিত বরুণের নৈতিক ঐশ্বর্যের কথা স্পষ্টভাবে মনে রাখা দরকার।
ঋগ্বেদে দেখা যায় নৈতিক নিয়মের চূড়ান্ত দায়িত্ব বরুণেরই উপর।
পরি স্পশো বরুণস্য স্মদিষ্টা উভে পশ্যন্তি রোদসী সুমেকে।
ঋতাবানঃ কবয়ো যজ্ঞধীরাঃ প্রচেতসো য ইষয়ন্ত মন্ম।।
অর্থাৎ, —বরণের সহচরগণ মঙ্গল-উদ্দেশ্যে স্বর্গ ও পৃথিবী পরিদর্শন করে, তাঁহারই ভয়ে ঋতযুক্ত, ক্রান্তদর্শী যজ্ঞধীর বিজ্ঞগণ তাঁহার উদ্দেশ্য স্তুতি প্রেরণ করেন।। ঋগ্বেদ : ৭.৮৭.৩ ।।
ঋগ্বেদে দেখা যায় অমৃত বা মিথ্যার বিরুদ্ধে বরুণের কঠোর বিধান।
যুবং বস্ত্রাণি পীবসা বসাথে যুবোরচ্ছিদ্রা মন্তবো হ সৰ্গাঃ। অবাতিরতমনৃতানি বিশ্ব ঋতেন বিশ্ব ঋতেন মিত্রাবরণ সচেথে।।
অর্থাৎ, —হে মিত্রাবরুণ, তোমরা স্থল বস্ত্রদ্বারা আচ্ছন্ন কর; তোমাদের সৃষ্টি ছিদ্রহীন ও মননযুক্ত; (তোমরা) অনৃতকে ধ্বংস করিয়াছিলে এবং বিশ্বকে ঋতের সহিত যুক্ত করিয়াছিলে।। ঋগ্বেদ : ১.১৫২.১ ।।
ইমে চেতারো অনৃতস্য ভূরের্মিত্রো অর্যমা বরুণো হি সন্তি।
ইম ঋতস্য বাবৃধুর্দুরোণে শগ্মাসঃ পুত্রা অদিতেরদদ্ধাঃ।।
অর্থাৎ,—মিত্র, অর্যমা ও বরুণ—ইহারা প্রভূত অমৃতের হন্তা; অদিতির অহিংসিত সুখকর পুত্ৰগণ গৃহে ঋতকে বর্ধিত করিয়াছিলেন।। ঋগ্বেদ : ৭.৬৪.৫ ।৷
বরুণ শুধু অনৃত-হন্তা নন, ঋতের পালক, ঋতের বর্ধক। বস্তুত, ঋতের সঙ্গে তাঁর এই সম্পর্কের দিক থেকেই বরুণের নৈতিক গৌরবের সবচেয়ে বড়ো পরিচয়। ঋতের কথা আমরা একটু পরেই তুলবো। তার আগে, এখানে, অধ্যাপক রথ্-এর একটি মতবাদ উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হতে পারে।
অধ্যাপক রথ্(৭৯) অনুমান করছেন যে, ঋগ্বেদ রচিত হবার যুগেই বৈদিক কবিদের কল্পনায় ইন্দ্রের গৌরব বরুণের চেয়ে অনেক বড়ো হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ আগে বরুণই ছিলেন বৈদিক মানুষদের প্রধানতম দেবতা এবং তাঁরই গৌরব সর্বাধিক। যতোই দিন গিয়েছে ততোই বরুণের গৌরব মান হয়েছে এবং তারই জায়গায় ইন্দ্রের গৌরব চূড়ান্ত হয়ে উঠেছে— এ-পরিবর্তন ঋগ্বেদ রচিত হবার সুদীর্ঘ যুগটির মধ্যেই সাধিত হয়েছে। এই মতের পক্ষে একটি প্রমাণ হিসেবে দেখানো হয়েছে যে, ঋগ্বেদের সবচেয়ে অর্বাচীন অংশে—দশম মণ্ডলে—বরুণের গৌরব-বর্ণনায় একটিও সূক্ত নেই; অপরপক্ষে পয়তাল্লিশটি যুক্ত ইন্দ্রের মহিমায় মুখর। কিন্তু অধ্যাপক ম্যাকডোন্যাল(৮০) বলছেন, সূক্তসংখ্যা-নির্ভর এ-জাতীয় যুক্তির মূল্য খুব বেশি নয়। কেননা সামগ্রিকভাবে ঋগ্বেদে বরুণের তুলনায় ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে রচিত সূক্ত অনেক বেশি; তৃতীয় মণ্ডলেও বরুণের উদ্দেশ্যে কোনো সূক্ত নেই, কিন্তু ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে বাইশটি সূক্ত আছে; দ্বিতীয় মণ্ডলে ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে তেইশটি সূক্ত, তুলনায় বরুণের উদ্দেশ্যে মাত্র একটি।
অধ্যাপক ম্যাকডোন্যাল-এর এ-যুক্তি নিশ্চয়ই স্বীকার্য : সূক্তসংখ্যার দিক থেকে বৈদিক দেবতাদের আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ণয় করবার প্রচেষ্টা নির্ভরযোগ্য নয়। তবুও আমরা বৈদিক সাহিত্যের আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকেই অধ্যাপক রথ্-এর এই মতবাদটির পক্ষেই কিছু সমৰ্থন পেতে পারি।
তং ব ইন্দ্ৰং ন সূক্রতুং বরুণমিব মায়িনম্।
অর্থাৎ, —(হে মরুৎগণ), তোমরা ইন্দ্রকে শোভন যজ্ঞ বিশিষ্ট মায়াযুক্ত বরুণের ন্যায় (দেখিবে) ॥ ঋগ্বেদ : ৬.৪৮.১৪ ॥
‘মায়া’র আলোচনায় আমরা পরে প্রত্যাবর্তন করবো। আপাতত প্রশ্ন হলো, উপরের উদ্ধৃতি থেকে কি এই কথাই অনুমান করা যায় না যে, ইতিপূর্বে বরুণকে যে-চোখে দেখা হতো ইন্দ্রকেও সেই চোখে দেখবার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে—অর্থাৎ বরুণের অতীত গৌরবই ইন্দ্রের উপর আরোপ করার আয়োজন হচ্ছে? অন্যত্রও এ-জাতীয় আভাস পাওয়া যায়।
ত্বং নো মিত্রো বরুণো ন মায়ী পিত্বো ন দস্ম দয়সে বিভক্তা।
অর্থাৎ,–মিত্র ও বরুণের ন্যায় মায়াযুক্ত হইয়া, হে দর্শনীয় (ইন্দ্র), তুমি আমাদিগের অন্নের বিভক্তা ও দাতা হও।। ঋগ্বেদ : ১০.১৪৭.৫ ।।
এর থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে, এককালে মিত্র ও বরুণই মায়াযুক্ত হয়ে অন্নের দাতা ও বিভক্তা ছিলেন; এই ঋকটির রচনাকালে ইন্দ্রকেও সেই গৌরবে গৌরবান্বিত করে তোলবার আয়োজন হচ্ছে।