দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা এখানে ঐতরেয় ব্রাহ্মণ(৭১) থেকে শুনশেপ-এর কাহিনী উদ্ধৃত করবো।
রাজা হরিশ্চন্দ্রের ছেলে হয়নি। বরুণের কাছে তিনি প্রার্থনা করেছিলেন, ‘আমার পুত্র হউক, তাদ্বারা তোমার যাগ করিব।’ বরুণ বললেন, তাই হোক। তখন তাঁর রোহিত নামে পুত্র জন্মালো! বরুণ হরিশ্চন্দ্রকে বললেন, ‘তাহলে তুমি এই পুত্র দিয়ে আমার যাগ করো’। হরিশ্চন্দ্র সময় নিতে লাগলেন : ছেলে একটু বড়ো হোক, ইত্যাদি। সন্নাহপ্রাপ্তি (ধনুর্বান, কবচাদি ধারণ) হবার পর রোহিত অরণ্যে প্রস্থান করলেন এবং অরণ্যে বিচরণ করতে লাগলেন। বরুণ হরিশ্চন্দ্রকে চেপে ধরলেন; হরিশ্চন্দ্রের উদরী রোগ উৎপন্ন হলো। রোহিত ষট্ সংবৎসর অরণ্যে বিচরণ করলেন।
এবং সূয়বসের পুত্র ক্ষুধাপীড়িত অজীগর্তকে দেখিতে পাইলেন। এই অজীগর্তের শুনঃপুচ্ছ, শুনঃশেপ, শুনোলাঙ্গুল নামে তিন পুত্র ছিল। তিনি সেই অজীগর্তকে বলিলেন, অহে ঋষি, তোমাকে একশত (গাভী) দিতেছি, আমি ইহাদের (তোমার পুত্রদের) মধ্যে একজনকে নিষ্ক্রয়রূপে দিয়া আপনাকে মুক্ত করিব। তখন অজীগর্ত জ্যেষ্ঠ পুত্রকে টানিয়া লইয়া বলিলেন, আমি ইহাকে কিছুতেই দিব না। মাতা (অজীগর্তের পত্নী) কনিষ্ঠকে (টানিয়া লইয়া) বলিলেন, আমি ইহাকে দিব না। তাঁহারা উভয়ে মধ্যম শুনঃশেপকে দান করিলেন। তখন অজীগর্তকে একশত (গাভী) দিয়া তিনি সেই শুনঃশেপকে লইয়া অরণ্য হইতে গ্রামে আসিলেন। (তদনন্তর) তিনি পিতার নিকট গিয়া বলিলেন, অহে, আমি এই ব্যক্তিকে নিষ্ক্রয় (মূল্য) স্বরূপ দিয়া আপনাকে মুক্ত করিতে চাহি। তখন হরিশ্চন্দ্র রাজা বরুণকে বলিলেন, আমি এই ব্যক্তিদ্বারা তোমার যাগ করিব। বরুণ বলিলেন, তাহাই হউক—ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় অপেক্ষা অধিক আদরণীয়। এই বলিয়া তাহাকে রাজসূয় নামক যজ্ঞক্রতু অনুষ্ঠান করিতে বলিলেন। হরিশ্চন্দ্রও রাজসূয়ের অভিষেক অনুষ্ঠানের দিনে শুনঃশেপকে পুরুষ (মনুষ্য) পশুরূপে নির্দেশ করিলেন।
সেই হরিশ্চন্দ্রের (রাজসূয় যাগে) বিশ্বামিত্র হোতো, জমদগ্নি অধ্বর্যু, বশিষ্ঠ ব্ৰহ্মা ও অয়াস্ত উদগাতা হইয়াছিলেন; পশুর উপকরণের পর নিযোক্তা (যুপে বন্ধনকর্তা) পাওয়া গেল না। সেই সূয়বসের পুত্র অজীগর্ত বলিলেন, আমাকে আর একশত (গাভী) দাও, আমি ইহাকে নিয়োজন (যুপে বন্ধন) করিব। তখন হরিশ্চন্দ্র তাঁহাকে আর একশত গাভী দিলেন; তিনিও নিয়োজন করিলেন।
উপকরণ ও নিয়োজনের পর আপ্রীমন্ত্র পঠিত ও পর্যাগ্নিকরণ অনুষ্ঠান সমাপ্ত হইলে বিশসন (বধ) কর্মের জন্য কাহাকেও পাওয়া গেল না। তখন অজীগর্ত বলিলেন, আমাকে আর একশত (গাভী) দাও, আমি ইহার বিশসন (বধ) করিব। তখন হরিশ্চন্দ্র তাঁহাকে আর একশত (গাভী) দিলেন। তখন তিনি অসি (খড়্গ) শানাইয়া (তীক্ষ্ণ করিয়া) উপস্থিত হইলেন।
ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে প্রতিফলিত বৈদিক সমাজের একটা ছবি এখানে পাওয়া যাচ্ছে : ক্ষুধাপীড়িত পিতা একশত গাভীর বিনিময়ে পুত্রকে বিকিয়ে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, আরো একশত গাভীর লোভে পুত্রকে যূপে বদ্ধ করতে অগ্রসর হচ্ছে। আরো একশত গাভীর প্রলোভনে খড়্গ শানিয়ে স্বয়ং পুত্রকে বধ করতে উদ্যত হচ্ছে।
এর পাশে ঋগ্বেদের দ্বিতীয় মণ্ডলের সেই ধুয়াটি মনে রাখা যায়; বৃহৎ বদেম বিদখে সুবীরাঃ–আমরা সভায় উচ্চকণ্ঠে বীর পুত্রের কামনা জানাই। ব্রাহ্মণ সাহিত্য যাঁরা রচনা করেছিলেন তাদেরই পূর্বপুরুষদের কাছে এইটিই ছিলো একটি প্রধানতম কামনা। কিন্তু ইতিমধ্যে বৈদিক মানুষদের সমাজে অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। সে পরিবর্তনের দরুন বৈদিক মানুষদের চিন্তাচেতনাও অনেকখানি রূপান্তররিত হয়েছে। এখানে তার সামান্য আলোচনা তুলবো।
————
৭১. বৈদিক সাহিত্যে শুনঃশেপ–এর কাহিনীর অন্যান্য উল্লেখও পাওয়া যায়। A. B. Keith RVB 61-8.
১৩. বরুণের ইতিবৃত্ত : দেবতার রূপান্তর
প্রাক্-বিভক্ত সমাজের ধ্বংসস্তুপের উপর শ্রেণীসমাজের আবির্ভাব-প্রসঙ্গে এঙ্গেলস্(৭২) বলছেন, the greed for wealth divided the members of the gentes…
লোভ। বৈদিক সাহিত্যে দেখতে পাই সমাজে এই লোভ যতোই সর্বশক্তি হয়ে উঠছে ততোই পরিবর্তন ঘটছে বৈদিক দেবতার চরিত্রেও। ওই লোভই হয়ে দাঁড়াচ্ছে দেবচরিত্রের একটি প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বরুণের কী রকম পরিণতি ও রূপান্তর ঘটেছে শুনঃশেপের কাহিনী অবলম্বন করেই তা দেখা যাক।
হরিশ্চন্দ্র বরুণ রাজাকে প্রার্থনা করিলেন, আমার পুত্র হউক, তারা তোমার যাগ করিব। (বরুণ বলিলেন) তাহাই হউক। তখন উহার রোহিত নামের পুত্র জন্মিল। তখন বরুণ হরিশ্চন্দ্রকে বলিলেন, তোমার পুত্র জন্মিয়াছে, তারা : আমার যাগ কর। তিনি তখন বলিলেন, (জন্মের পর অশৌচকালে) দশ দিন গত না হইলে পণ্ড মেধ্য (যাগযোগ্য) হয় না; ইহার দশদিন উত্তীর্ণ হোক, তখন তোমার যাগ করিব। বরুণ বলিলেন, তাহাই হউক।
পরে দশদিন উত্তীর্ণ হইলে বরুণ বলিলেন, দশ দিন উত্তীর্ণ হইয়াছে। এখন এতদ্বারা আমার যাগ কর। তিনি বলিলেন, যখন পণ্ডর দাঁত ওঠে, তখন সে মেধ্য হয়; ইহার দাঁত বাহির হউক, তখন তোমার যাগ করিব। বরুণ বলিলেন, তাহাই হউক।
পরে তাহার দাঁত উঠিলে বরুণ বলিলেন, ইহার দাঁত উঠিয়াছে, এখন এতদ্বারা আমার যাগ কর। তিনি বলিলেন, পশুর দাঁত যখন পড়িয়া যায় তখন সে মেধ্য হয়; ইহার দাঁত পড়ুক, তখন তোমার যাগ করিব। বরুণ বলিলেন, তাহাই হউক।
পরে তাহার দাঁত পড়িলে বরুণ বলিলেন, ইহার দাঁত পড়িয়াছে, এখন এতদ্বারা যাগ কর। তিনি বলিলেন, পশুর দাঁত যখন আবার জন্মে, তখন সে মেধ্য হয়; ইহার দাঁত আবার উঠুক, তখন তোমার যাগ করিব। বরুণ বলিলেন, তাহাই হউক।
পরে তাহার দাঁত আবার উঠিলে বরুণ বলিলেন, ইহার দাঁত আবার উঠিয়াছে, এখন এতদ্বারা আমার যাগ কর। তিনি বলিলেন, ক্ষত্রিয় যখন সন্নাহ (ধনুর্বাণ কবচাদি) ধারণে সমর্থ হয়, তখন সে মেধ্য হয়। এ সন্নাহ প্রাপ্ত হইলে তোমার যাগ করিব। বরুণ বলিলেন, তাহাই হউক।
পরে সেই (বালক) সন্নাহ প্রাপ্ত হইলে বরুণ বলিলেন, এ সন্নাহ প্রাপ্ত হইয়াছে, এখন এতদ্বারা আমার যাগ কর। তাহাই হউক বলিয়া হরিশ্চন্দ্র পুত্রকে ডাকিয়া বলিলেন; হায়, তোমাদ্বারা আমাকে ইহার যাগ করিতে হইবে। তাহা হইবে না, এই বলিয়া সেই রোহিত ধনু গ্রহণ করিয়া অরণ্যে প্রস্থান করিলেন ও সংবৎসর ধরিয়া অরণ্যে বিচরণ করিলেন।
তখন বরুণ ইক্ষ্বাকুবংশধরকে চাপিয়া ধরিলেন, তাঁহার উদরী রোগ উৎপন্ন হইল……(৭৩)