অতীতে কী রকম ছিলো? ধনী যজমানের পক্ষে অর্থব্যয় করে ঋত্বিক নিয়োগের পরিচয় নেই; তার বদলে যজমান নিজেই যজ্ঞকর্মে অংশগ্রহণ করতেন। যজমান শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থই তার একমাত্র প্রমাণ নয়; ঋগ্বেদে দেখা যায় সোমসবন, হবিপ্রদান প্রভৃতি ঋত্বিক-কর্ম যজমান স্বয়ংই সম্পাদন করছেন। আরো উল্লেখযোগ্য হলো, যজমান বলতে ব্যক্তিবিশেষ নন—অনেকে; তাই ‘যজমানগণ’। কিন্তু ঋগ্বেদের সাক্ষ্য অনুসারেই দেখা যায়, যজমানের সঙ্গে হোতা, ঋত্বিক প্রভৃতির পার্থক্য ক্রমশই ফুটে উঠছে। তখনো কিন্তু অসিক্নীতীরে যজমান এবং হোতার মধ্যে প্রভেদ ফুটে ওঠেনি : অসিক্নীতীরে যজমানই যেন হোতা। ঋগ্বেদের অর্বাচীনতম অংশে আমরা দেখছি, যজ্ঞ কর্মের সঙ্গে এবং যজ্ঞকৰ্ম-সম্পকিত জ্ঞানের সঙ্গে যজমানের কোনো সম্পর্কই নেই : সমস্ত যজ্ঞকৰ্মই যখন ঋত্বিকের উপর নির্ভরশীল তখন আর যজমানের পক্ষে চৈতন্তের প্রয়োজন কী? এর সঙ্গে প্রাচীনকালের সোমসবনকারী যজমানগণের তুলনা করলে বৈদিক যজ্ঞে কতোখানি রূপান্তর ঘটেছিলো তার আভাস পাওয়া যেতে পারে।
অতএব, অনুমিত হয় উত্তরকালে যজ্ঞের যাই পরিণতি হোক না কেন, অতীতে তা যৌথ কর্মপদ্ধতিই ছিলো।
কিন্তু সেই যৌথ-কর্মপদ্ধতির উদ্দেশ্য তখন কী? লোকোত্তর নয়; লোকায়তিক। অয়লাভ। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে তার ইংগিত অস্পষ্ট নয়। “যজ্ঞ দেবগণের নিকট হইতে ‘আমি তোমাদের অন্ন হইব না’, ইহা বলিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন”। “একদা যজ্ঞ ভক্ষ্য-অন্নসমেত দেবগণের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছিলেন। দেবগণ বলিলেন, যজ্ঞ ভক্ষ্য-অন্নসমেত আমাদের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছেন, এই যজ্ঞের অনুসরণ করিয়া আমরা অন্নেরও অনুসরণ করিব”। যা চলে গেলে ভক্ষ্য-অন্নও চলে যায়, যাকে অনুসরণ করলে ভক্ষ্য-অন্নেরও অমুসরণ করা হয় তাকে অন্নলাভের পদ্ধতি বা উপায় হিসেবেই চেনবার চেষ্টা করা স্বাভাবিক। অতএব আমরা যজ্ঞের আদিরূপকে অন্ন-লাভের যৌথ কৌশল বা প্রাচীন প্রাক-বিভক্ত সমাজের যৌথ উৎপাদন-কৌশল বলেই গ্রহণ করতে চেয়েছি, যদিও কালক্রমে তা লোকোত্তরের মোহে এবং ব্যষ্টি-স্বার্থে নিযুক্ত হতে দেখা যায়। স্বভাবতই, আমাদের যুক্তি অনুসারে বৈদিক মানুষদের প্রাচীন প্রাক্-বিভক্ত সমাজ ভেঙে শ্রেণীসমাজের আবির্ভাবই এ-পরিবর্তনের মূল কারণ বলে প্রতীত হয়েছে।
————-
৬০. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ (ত্রিবেদী) ৫৬।
৬১. ঐ ১৮৩-৪ ।
৬২. ঐ ২৩৮ ।
৬৩. ঐ ৪৫০ ।
৬৪. ঐ ৪৫১।
৬৫. ঐ ।
৬৬. ঐ ৪৬৭ ।
৬৭. ঐ ৪৬৯ ।
৬৮. ঐ ৪৭০-১ ।
৬৯. A. B. Keith RVB 45.
৭০. F. Engels OFPPS276.
১১. ঋগ্বেদে ব্যষ্টিস্বার্থের আবির্ভাব
ঋগ্বেদের রচনাকাল অত্যন্ত সুদীর্ঘ এবং এ-কথা মনে করবার নিশ্চয়ই কোনো কারণ নেই যে, এই সুদীর্ঘ যুগ ধরে বৈদিক মানুষদের সমাজ-জীবন অপরিবর্তিত ছিলো। ঋগ্বেদ সংহিতায় কী ভাবে প্রাচীন সাম্য-সমাজের স্মৃতিচিহ্ন দেখতে পাওয়া সম্ভব তার আলোচনা আমরা ইতিপূর্বে করেছি; এবার সে-সমাজে ভাঙন ধরবার আভাস ঋগ্বেদ-সংহিতার মধ্যেই কী ভাবে দেখতে পাওয়া যায় তার একটি দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করবো।
ঋষভং মা সমানানং সপত্নানাং বিষাসহিম্।
হন্তারং শত্রুণাং কৃধি বিরাজং গোপতিং গবাম্।।
অর্থাৎ, —(হে ইন্দ্র) আমাকে সমানদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কর, শত্রুদিগের পরাজয়িতা কর, শত্রুদিগের হন্তা এবং গরুদিগের মধ্যে গোপতি কর।। ঋগ্বেদ : ১০.১৬৬.১৷৷
অভিভূরহমাগমং বিশ্বকৰ্মেন ধাম্না।
আ বশ্চিত্তম বোব্রতম বোহহং সমিতিং দদে।।
অর্থাৎ, আমি সর্বকর্মকারী শক্তির দ্বারা তোমাদিগকে (শত্রুদিগকে) অভিভূত করিতে আসিয়াছি; তোমাদের সমস্ত চিত্ত, কর্ম এবং সমিতিকে আমি অপহরণ করিলাম।। ঋগ্বেদ : ১০.১৬৬.৪৷৷
যোগক্ষেমং ব আদায়াহং ভূয়াসমুত্তম আ বো মূর্ধানক্রমীম্।
অধস্পদান্ম উধদত মণ্ডুকাইবোদকান্মণ্ডূকা উদকাদিব।।
অর্থাৎ,–তোমাদিগের (সপত্মদিগের) প্রাপ্ত ধনের অধিকারী হইয়া এবং আত্মসাৎ করিয়া আমি শ্রেষ্ঠ হইয়াছি এবং তোমাদের মস্তকে উঠিয়াছি; পদতল হইতে তোমরা চিংকার করিতেছ, ভেকের ন্যায়। ঋগ্বেদ : ১০.১৬৬.৫ ৷
এখানে শুধুই যে শক্ৰদের পদদলিত করবার কামনা ফুটে উঠেছে তাই নয়,—‘আমাদের’ কথাকে পদদলিত করে ‘আমাকে’, সামগ্রিক স্বার্থকে ধূলিসাৎ করে, ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খাকে চূড়ান্ত মর্যাদা দেওয়ার পরিচয়ও অস্পষ্ট নয়। কেননা, শত্রুজয় এবং শত্রুধন অপহরণ করবার প্রসঙ্গ ঋগ্বেদে বিরল নয়; কিন্তু, আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি, যেখানে প্রাচীন পর্যায়ের সমান-জীবনের স্মৃতি ম্লান হয়নি সেখানে ইন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে, অগ্নিকে উদ্দেশ্য করে সেই জিত-ধনের অংশ বণ্টন করে দেবার কামনাই জানানো হয়েছে।
১২. শুনঃশেপ-এর কাহিনী
সংহিতার পর ব্রাহ্মণ। ঋগ্বেদের প্রধান ব্রাহ্মণ বলতে ঐতরেয়। রচনাকালের দিক থেকে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলই সবচেয়ে অর্বাচীন। তাই এই দশম মণ্ডলের রচনাকালের সঙ্গে ঐতরেয় ব্রাহ্মণের রচনাকালের খুব বেশি ব্যবধান থাকার কথা নয়।
স্বভাবতই, বৈদিক সমাজে যে-পরিবর্তনের ফলে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে আমরা ওইভাবে প্রাচীন সমষ্টিজীবনকে ব্যক্তিস্বার্থের নিচে অবদলিত হতে দেখি, তারই অনুবৃত্তি ঐতরেয় ব্রাহ্মণে শ্রেণীবিভাগ-আবির্ভাবের বিভীষিকাকে আরো প্রকট করে তুলেছে।