ঐতরেয় ব্রাহ্মণের যুগে যে রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব ঘটেছিলো, এ-বিষয়ে আধুনিক বিদ্বানেরা অবশ্যই নিঃসন্দেহ, যদিও সেগুলি খণ্ড ও সীমাবদ্ধ রাষ্ট্রমাত্র। অধ্যাপক কীথ্(৬৯) যেমন ঐতরেয় ব্রাহ্মণের রাজনৈতিক পটভূমি প্রসঙ্গে বলছেন,
The political references do not hint at any great kingdoms, but at a large number of petty princes, who, despite their titles and claims to sovereignty, were doubtless rulers of limited portions of territory.
কিন্তু এই রাষ্ট্রশক্তি যে প্রাক্-বিভক্ত প্রাচীন সমাজের ধ্বংসস্তুপের উপরই আবির্ভূত হয়, সে-বিষয়ে আধুনিক বিদ্বানের সচেতন হতে চান না বলেই ঋগ্বেদের সমাজ থেকে—ঋগ্বেদের প্রাচীনতর অংশে যে সাম্যজীবনের আভাস পাওয়া যায় তা থেকে—এই ব্রাহ্মণ-বর্ণিত রাষ্ট্রশক্তির উদ্ভব কাহিনী আজো আমাদের কাছে অস্পষ্ট। আর এই কারণেই অস্পষ্ট হয়ে থেকেছে বৈদিক যজ্ঞের ইতিহাসটুকুও।
আমাদের যুক্তি অনুসারে, বৈদিক সমাজে রাষ্ট্রশক্তির এই আবির্ভাব এবং বৈদিক যজ্ঞের উপরোক্ত রূপান্তর, উভয়ই হলো বৈদিক মানুষদের জীবনে একটি মূল পরিবর্তনের দ্বিবিধ পরিণাম। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের রচনাকালে এই মূল পরিবর্তনটি প্রকট হয়েছিলো, কেননা ঐতরেয় ব্রাহ্মণে আমরা ওই দ্বিবিধ পরিণামেরই সুস্পষ্ট পরিচয় পাই।
ঋগ্বেদের সাক্ষ্য অনুসারে অনুমান করা যায়, অতীতে বৈদিক মানুষেরাও সমাজ-বিকাশের প্রাক্-বিভক্ত পর্যায়ে—আদিম সাম্যাবস্থায়—জীবন-যাপন করতেন। তখনো তারা লেখার হরফ আবিষ্কার করেননি; মুখেমুখে গান রচনা করতেন। পার্থিব সুখ-সম্পদের কামনাই সে-গানের প্রাণবস্তু। এ-সম্পদ কিন্তু একার জন্য নয়—সকলের জন্য, সমষ্টির জন্য : ‘আমার’ নিজের জন্য চাওয়া নয়, ‘আমাদের’ সকলের জন্য চাওয়া। এবং এ-সম্পদ কারুর একার নয় বলেই তাতে সকলের সমান অধিকার—সমান অংশ, সমান ভাগ, সমান ভগ। অতএব এ-পর্যায়ে সমবণ্টন বা অংশবণ্টনের প্রসঙ্গও স্বাভাবিক। কোথাও কোথাও দেখা যায় মানুষেরা নিজেরাই অংশবণ্টনের কাজে ব্যাপৃত হয়েছেন; কিন্তু প্রধানত দেবতাদের উপরই তার দায়িত্ব ছিলো। কিন্তু বৈদিক দেবতাদের তখনো আধুনিক আধ্যাত্মিক অর্থে দেবত্বপ্রাপ্তি ঘটেনি। তাই প্রায়ই তাদের ‘সখা’ বলে এবং কখনো বা নিরদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ‘নর’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং আদিম সাম্যসমাজের পরিচায়ক হিসেবে শুধুই যে ঋগ্বেদের মানুষেরাই পরস্পরের সঙ্গে সমান তাই নয়, দেবতারাও পরস্পরের সঙ্গে সমান; এমনকি অতীতে দেবতারাও যে মানুষের সঙ্গে সমান ছিলেন বা মানুষেরাও দেবতাদের সঙ্গে সমান হয়েছিলেন—তার স্মৃতিটুকুও ঋগ্বেদ থেকে বিলুপ্ত হয়নি। স্বভাবতই, দেবতারাও মানুষের মতো সচেতনভাবে একত্র তাদের ভাগ গ্রহণ করতেন এবং সভায় গমন করতেন।
অন্যান্য প্রাচীন সমাজের মতোই বৈদিক সমাজের প্রাচীন পর্যায়েও সমবণ্টনের কৌশল হিসেবে অক্ষের ব্যবহার হতো কিনা তা ভেবে দেখবার অবকাশ আছে। হয়তো বৈদিক সভাতে এই কৌশলে অংশ-বণ্টন হতে বলেই সভাস্থান এবং দূতগৃহ অনেকাংশেই অভিন্ন ছিলো। এই কারণেই অক্ষকে মহৎগণের সেনানী এবং ব্রাতর রাজা বলে কল্পনা করা হয়েছিলো কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এই সভা বা বিদথই ছিলো ধন-বিভাগ বা অংশ-বণ্টনের স্থান।
অতএব, ঋগ্বেদের অন্তত প্রাচীনতর অংশগুলিতে রাষ্ট্রশাসনের উল্লেখ অস্বাভাবিক হবে। এবং সে-উল্লেখ দেখা যায় না। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, সে-পর্যায়ে বৈদিক সমাজের শাসন পরিচালনের কাজ কী ভাবে চলতো? ট্রাইব্যাল সমাজে যে-ভাবে চলে—অর্থাৎ, সভা-সমিতির উপর নির্ভর করেই। এইদিক থেকেই আমরা ঋগ্বেদে সভা, সমিতি ও বিদধের অমন অসামান্য গৌরবকে বোঝবার চেষ্টা করেছি। ঋগ্বেদোত্তর সাহিত্যে সভা, সমিতি ও বিদখের এই অতীত গৌরব ম্লান হয়েছে এবং মহাভারতাদিতে তা বিলুপ্ত হয়েছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে দেখা যায়, সভা-সমিতির মহিমার পরিবর্তে জেগে উঠছে ব্ৰহ্মসমর্থিত ও ক্ষত্ৰ-শাসিত রাষ্ট্রশক্তির মহিমা। এ-রাষ্ট্রের উদ্ভব হলো কী করে? ঐতিহাসিক বিবর্তনের সাধারণ নিয়ম হিসেবে আমরা জানি, জ্ঞাতিভিত্তিক প্রাক্-বিভক্ত সমাজের ধ্বংসস্তূপের উপরই রাষ্ট্রের আবির্ভাব হয় :
…the state was built on the ruins of the gentile constitution.(৭০)
বৈদিক মানুষদেরও প্রাক্-বিভক্ত প্রাচীন জ্ঞাতিভিত্তিক সমাজ কালক্রমে ভেঙে গিয়েছিলো এবং তারই ধ্বংসস্তুপের উপর আবির্ভূত হয়েছিলো শ্রেণীবিভক্ত সমাজ। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের পরিভাষায় নবপর্যায়ের শাসক-শ্রেণী বলতে প্রধানতই ক্ষত্র এবং শাসন-যন্ত্রের নাম রাষ্ট্র—যদিও ওই ক্ষত্র ব্রহ্ম-সমর্থিত বা ব্রাহ্মণ-সমর্থিত।
আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি, বৈদিক মানুষদের জীবনে এই মৌলিক পরিবর্তনটিরই আর-এক পরিণাম হলো বৈদিক যজ্ঞের রূপান্তর। সে-রূপান্তরের মূল কথা কী? সংক্ষেপে : অতীতে অনুষ্ঠান-নির্ভরতা (ritual) সত্ত্বেও যা ছিলো লোকায়তিক কামনা-চরিতার্থতার—অন্ন-লাভের—যৌথ পদ্ধতি, কালক্রমে তা শুধুই যে লোকোত্তরের কল্পনায় অনুষ্ঠান-মাত্রে পরিণত হলো তাই নয়, সামগ্রিক স্বাৰ্থ থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থে নিযুক্ত বলেও কল্পিত হলো।