একদা যজ্ঞ ভক্ষ্য-অন্নসমেত দেবগণের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছিলেন। দেবগণ বলিলেন, যজ্ঞ ভক্ষ্য-অন্নসমেত আমাদের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছেন, এই যজ্ঞের অনুসরন করিয়া আমরা অন্নেরও অন্বেষণ করিব। তাঁহারা বলিলেন, কিরূপে অন্বেষণ করিব? ব্রাহ্মণদ্বারা ও ছন্দোদ্বারা (অন্বেষণ) করিব। এই বলিয়া তাঁহারা (দীক্ষণীয়েষ্টি) যজ্ঞকে সমাপ্তি পৰ্যন্ত বিস্তৃত করিয়াছিলেন; অপিচ (দেব-) পত্নীগণেরও সংযোগ করিয়াছিলেন। সেই হেতু এখনও দীক্ষণীয়া ইষ্টতে যজ্ঞকে সমাপ্তি পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয় ও (দেব-) পত্নীগণেরও সংযোগ করা হয়। (দেবগণকৃত) সেই কর্মের অনুসরণ করিয়া মনুষ্যরাও তদ্রুপ করিয়া থাকে।… এইরূপে উত্তরোত্তর সারবান কর্মের অনুষ্টান দ্বারা দেবগণ এই যজ্ঞকে পাইয়াছিলেন…
সেই যজ্ঞকে পাইয়া দেবগণ বলিলেন, (অহে যজ্ঞ), তুমি আমাদের ভক্ষণীয় আয়ের জন্য অবস্থান কর। যজ্ঞ বলিলেন, না, কেন আমি তোমাদের জন্য অবস্থান করিব? এই বলিয়া যজ্ঞ দেবগণের প্রতি দৃষ্টিক্ষেপ করিলেন। দেবগণ তাঁহাকে বলিলেন, ব্রাহ্মণদ্বারা ও ছন্দোদ্বারা সংযুক্ত হইয়া তুমি ভক্ষণীয় অন্নের জন্য অবস্থিতি কর। (যজ্ঞ বলিলেন), তাহাই হইবে। সেইহেতু অদ্যাপি যজ্ঞ ব্রাহ্মণদ্বারা ও ছন্দোদ্বারা সংযুক্ত হইয়া দেবগণের নিকট হব্য বহন করিয়া থাকেন।(৬২)
শুধু তাই নয়। ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণেই এমন ইংগিত পাওয়া অসম্ভব নয় যে, পরবর্তী যুগে পুনর্গঠিত ওই যজ্ঞের সঙ্গে শ্রেণীসমাজের নির্দিষ্ট শ্রেণীরই সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো :
প্ৰজাপতি যজ্ঞের সৃষ্টি করিয়াছিলেন; যজ্ঞসৃষ্টির পর ব্ৰহ্ম ও ক্ষত্রের সৃষ্টি করিলেন ও ব্ৰহ্মক্ষত্রের পর এই দ্বিবিধ প্ৰজার সৃষ্টি করিলেন। ব্ৰহ্মের অনুরপ হুতাদ এবং ক্ষত্রের অনুরূপ অহুতাদ সৃষ্টি করিলেন। এই যে ব্রাহ্মণগণ, ইঁহারাই হুতাদ (হুতশেষভোজী) প্রজা; আর রাজন্য বৈশ্য ও শূদ্র, ইঁহারাই অহুতাদ। যজ্ঞ তাঁহাদের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছিল; ব্ৰহ্ম ও ক্ষত্র যজের অনুগমন করিয়াছিলেন। ব্রহ্মের যে-সকল আয়ুধ তাহার সহিত ব্ৰহ্ম ও ক্ষত্রের যে-সকল আয়ুধ তাহার সহিত ক্ষত্র,—তাহার অনুগমন করিয়াছিলেন। যজ্ঞের যে-সকল আয়ুধ তাহাই ব্রহ্মের আয়ুধ; আর অশ্বযুক্ত রথ, কবচ ও বাণযুক্ত ধনু-ইহাই ক্ষত্রের আয়ুধ। ক্ষত্রের আয়ুধে ভয় পাইয়া যজ্ঞ না ফিরিয়া পলাইতে লাগিল; ক্ষত্র তাহাকে ধরিতে না পাইয়া ফিরিয়া আসিলেন। ব্ৰহ্ম তাহার অনুসরণ করিয়া তাহাকে ধরিয়া ফেলিলেন ও তৎপরে তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া তাহার গতি (পথ) রোধ করিলেন। এইরূপে (পথ) রুদ্ধ হইলে যজ্ঞ দাঁড়াইল এবং ব্রহ্মের নিকট আপনারই আয়ুধসকল দেখিয়া তাহার নিকট উপস্থিত হইল। সেই হেতু অদ্যাপি যজ্ঞ ব্রহ্মস্বরূপ ব্রাহ্মণেই প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। তখন ক্ষত্র সেই ব্রহ্মের অনুগমন করিয়া তাহাকে বলিলেন, আমাকে এই যজ্ঞে আহ্বান কর। ব্ৰহ্ম বলিলেন আচ্ছা, তাহাই হইবে; কিন্তু তুমি আপনার আয়ুধসকল ফেলিয়া দিয়া ব্রহ্মের আয়ুধ লইয়া ব্রহ্মের রূপ ধরিয়া ব্রহ্মসদৃশ হইয়া যজ্ঞের নিকট উপস্থিত হও। “তাহাই হউক” বলিয়া ক্ষত্র আপন আয়ুধ ফেলিয়া ব্রহ্মের আয়ুধ গ্রহণ করিয়া ব্রহ্মের রূপ ধরিয়া ব্রহ্মসদৃশ হইয়া যজ্ঞের নিকট উপস্থিত হইলেন। সেইহেতু অদ্যাপি ক্ষত্রিয় যজমান আপন আয়ুধ ফেলিয়া ব্রহ্মের আয়ুধ গ্রহণ করিয়া ব্রহ্মের রূপ ধরিয়া ব্রহ্মসদৃশ হইয়া যজ্ঞের নিকট উপস্থিত হন।(৬৩)
ঐতরেয় ব্রাহ্মণের সামাজিক পটভূমিতে কীভাবে ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূত্র প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিভেদাদি প্রকট হয়ে পড়েছিলো তারই দৃষ্টান্ত হিসেবে এখানে কয়েকটি উদ্ধৃতি অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
যে যজমান যজ্ঞ আরম্ভ করে, সে ব্রাহ্মণেরই শরণ লয়; কেননা যজ্ঞ ব্রহ্মস্বরূপ।…ব্রহ্মের শরণাপন্ন সেই যজমানকে ক্ষত্র হিংসা করিতে পারে না। আর “ব্রহ্ম মা ক্ষত্রাদ্ গোপায়তু” এই মন্ত্রাংশ বলিলে ব্ৰহ্ম সেই যজমানকে ক্ষত্র হইতে রক্ষা করেন। আর “ব্রহ্মণে স্বাহা” বলিলে ব্রহ্মকে প্রীত করা হয়; ব্ৰহ্ম প্রীত হইয়া তাহাকে ক্ষত্র হইতে রক্ষা করেন।…(৬৪)
কিংবা
যে ব্যক্তি রাষ্ট্র লাভ করে সে ক্ষত্রের শরণ লয়; রাষ্ট্রই ক্ষত্রস্বরূপ। ক্ষত্রের শরণাপন্ন সেই যজমানকে ব্ৰহ্ম হিংসা করিতে পারেন না। আর ক্ষত্র তাহাকে ব্ৰহ্ম হইতে রক্ষা করিবে, এই উদেশে “ক্ষত্ৰং মা ব্রাহ্মণে গোপায়ুতু” বলা হয়; আর “ক্ষত্রায় স্বাহা” বলিলে ক্ষত্রকে প্রীত করা হয়; ক্ষত্র প্রীত হইয়া তাহাকে ব্ৰহ্ম হইতে রক্ষা করেন।…(৬৫)
কিংবা
ব্ৰহ্ম ক্ষত্রের পূর্ববর্তী; ব্ৰহ্ম পূর্ববর্তী থাকিলে ক্ষত্রিয় যজমানের রাষ্ট্রও উগ্র হইয়া অন্যের নিকট ব্যথা পায় না।…(৬৬)
কিংবা
ক্ষত্র নিশ্চয়ই ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত এবং ব্রহ্মও ক্ষত্রে প্রতিষ্ঠিত…(৬৭)
কিংবা
ব্ৰহ্ম ক্ষত্রের পূর্ববর্তী; ব্রহ্ম পূর্বে থাকিলে যজমানের রাষ্ট্র উগ্র হইবে না এবং অপরের নিকট ব্যথা পাইবে না। সপ্তদশ স্তোম বৈশ্বস্বরূপ এবং একবিংশ স্তোম শূদ্রবর্ণের অনুরূপ। এতদ্বারা বৈশ্যকে ও শূদ্ৰবৰ্ণকে ক্ষত্রিয়ের বর্ত্মানুগামী করা হয়।।…(৬৮)