তাহলে, যজমান শব্দের ইতিহাস থেকেই অনুমান করা যায় যে, বৈদিক যজ্ঞের আদি-তাৎপৰ্য ও উত্তর-তাৎপৰ্য অভিন্ন নয়—কেননা, যজ্ঞ বলতে এককালে যৌথ-অনুষ্ঠান বোঝাতে যদিও উত্তরকালে তা বোঝায়নি। কিন্তু অতীতের ওই যৌথ-অনুষ্ঠান ঠিক কিসের উদ্দেশ্যে ছিলো? বৈদিক সাহিত্যের অন্যান্য সাক্ষ্য বিচার করে এবার আমরা এই প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধান করবো।
যজুৰ্বেদ নামটির মধ্যেই একটা অতীতের ইংগিত আছে। যজুঃ+ বেদ। যজুঃ=যজ্+লিট্ উস্–অর্থাৎ যজ্ঞ করিয়াছিল (বহুবচনে)।
যজ্ঞানুষ্ঠান—অর্থাৎ, আদি অকৃত্রিম অর্থে যজ্ঞানুষ্ঠান—অতীদের ঘটনা।
অতীতে, ঠিক কিসের উদ্দেশ্যে, যজ্ঞের অনুষ্ঠান? যজুর্বেদেরই একটি শাখার নাম বিশ্লেষণ করলে এ-প্রশ্নের উত্তর-অন্তত উত্তরের ইংগিত—পাওয়া
অসম্ভব না হতেও পারে। শাখাটির নাম, বাজসনেয়ী সংহিতা। বাজ মানে অন্ন–ঋগ্বেদে এই অর্থে শব্দটির ব্যবহার বারবার পাওয়া যায়। বাজম্ অন্নম সনেীতি বর্ধয়তি ইতি বাজ+সন+অচ্=বাজসন। তস্য কৃতি (তৎকৃত গ্ৰন্থ) বাজসন+ ষ্ণেয়= বাজসনেয়।+স্ত্রিয়াং ঙীপ্=বাজসনেয়ী। অতএব, এই বাজসনেয়ী নামটির মধ্যেই অন্নবর্ধক-কৌশলের-productive technique-এর-ইংগিত পাওয়া অসম্ভব নয়।
——————-
৫৮. M. Monier-Williams SED—যজমান।
৫৯. ছান্দোগ্য উপনিষদ : প্রথম অধ্যায়, দশম ও একাদশ খণ্ড।
১০. ‘যজ্ঞ ভক্ষ্য-অন্নসমেত দেবগণের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছিলেন’
যজ্ঞানুষ্ঠান অতীতের ঘটনা এবং ভক্ষ্য-অন্ন লাভই সে অনুষ্ঠানের আদি-উদ্দেশ্য। এই বিষয়গুলিরই ইংগিত পাওয়া যায় ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণ থেকে। ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণে(৬০) বলা হয়েছে :
যজ্ঞ দেবগণের নিকট হইতে, ‘আমি তোমাদের অন্ন হইব না,’ ইহা বলিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন। দেবতারা বলিলেন-না, তুমি আমাদের অল্পই হইবে। দেবতারা তাঁহাকে (যজ্ঞকে) হিংসা করিয়াছিলেন। হিংসিত হইয়াও তিনি দেবগণের (অন্নরূপে) প্রভূত হন নাই। তখন দেবগণ বলিলেন, এইরূপে হিংসিত হইয়াও ইনি যখন আমাদের অন্ন হইলেন না, অহো, তখন আমরা এই (প্রবর্গ) যজ্ঞের সম্ভার (আয়োজন) করিব। তাহাই হউক বলিয়া, তাঁহারা যজ্ঞের সম্ভার করিয়াছিলেন।
সেই যজ্ঞের সম্ভা করিয়া (দেবতারা) বলিলেন, হে অশ্বিদ্বয়, (আমাদের কর্তৃক পীড়িত) এই যজ্ঞের চিকিৎসা কর। (কেননা) অশ্বিদ্বয়ই দেবগণের ভিষক্। (আবার) অশ্বিদ্বয়ই অধ্বর্যু; সেইজন্য অধ্বর্যুদ্বয় ঘর্মের (প্রবর্গের) সম্ভার (আয়োজন) করেন।
অতীতের সেই হারিয়ে-যাওয়া যজ্ঞকে কী ভাবে পুনর্গঠন করতে হবে, ঐতরেয়-ব্ৰাহ্মণে এর পর তারই সুদীর্ঘ বর্ণনা পাওয়া যায়।
ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণের এই উক্তিগুলির ইংগিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর থেকে কয়েকটি বিষয় অনুমান করা সম্ভব।
প্রথমত, ব্ৰাহ্মণ-বর্ণিত যজ্ঞ অতীতকালের যজ্ঞের বা যজ্ঞের আদিরূপের পুনরুল্লেখ নয়–পুনর্গঠন। আদি যজ্ঞ দেবতাদের কাছ থেকে চলে গিয়েছিলো। যজ্ঞ দেবতাদের দ্বারা হিংসিত হয়েছিলো। অশ্বিদায়-দ্বারা হিংসিত যজ্ঞের চিকিৎসা প্রয়োজন হয়েছিলো। এবং পুরাকালের কয়েকটি মন্ত্রকে অবলম্বন করে ব্ৰাহ্মণ-সাহিত্যে সেই আদি-যজ্ঞের বিভিন্ন অবয়ব ও প্ৰাণ পুনর্গঠন করবার প্রচেষ্টা হয়েছিলো।
দ্বিতীয়ত, পরবর্তী যুগে—ব্রাহ্মণ-সাহিত্যে-যজ্ঞের উদ্দেশ্য ঠিক কী এবিষয়ে আমাদের একটা ধারণা আছে। কিন্তু ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণের উদ্ধৃতি থেকে অনুমান করা যায়, আদি-পর্যায়েও যজ্ঞের উদ্দেশ্য হুবহু তাই নয়। আদি-পৰ্যায়ে উদ্দেশ্যটি ঠিক কী? ভক্ষ্য-অন্ন লাভ। কেননা, ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণে বলা হয়েছে, যজ্ঞ দেবগণের নিকট হইতে “আমি তোমাদের অন্ন হইব না’–ইহা বলিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন। দেবতারা বলিলেন, না তুমি আমাদের অন্নই হইবে।
উত্তরকালের যজ্ঞ যে অতীত যজ্ঞের পুনর্গঠনমাত্র–এ-কথা যদি ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণে মাত্র একবার উল্লিখিত হতো, তাহলেও তার সাক্ষ্য নিশ্চয়ই লঘুমূল্য হতো না। কিন্তু বস্তুত ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণে বারবার এই বিষয়টিরই উল্লেখ দেখা যায়।
যজ্ঞ দেবগণের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছিলেন। তাহারা প্ৰৈযদ্বারা সেই যজ্ঞকে প্রৈষ (আহ্বান) করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন, তাহাই প্রৈষের প্রৈষত্ব। দেবগণ পুরোরুক্সমূহ দ্বারা সেই যজ্ঞকে রুচিসম্পন্ন করিয়াছিলেন;…সেই যজ্ঞকে বেদিতে অনুবেদন (অনুকূলভাবে লাভ) কারিয়াছিলেন;…সেই যজ্ঞ বেদিতে লব্ধ হইলে পর উহাকে গ্রহদ্বারা (উপাংশু প্রভৃতি দ্বারা) গ্রহণ করিয়াছিলেন;…তাহাকে লাভ করিয়া নিবিৎসমূহের দ্বারা (দেবতার উদ্দেশ্যে) নিবেদন করিয়াছিলেন…
নষ্ট দ্রব্য পাইতে ইচ্ছা করিয়া, কেহ বা অধিক পাইতে ইচ্ছা করে, কেহ বা অল্প পাইতে ইচ্ছা করে। উভয়েয় মধ্যে যে অধিক পাইতে ইচ্ছা করে, সেই ব্যক্তি উভয়ের মধ্যে ভালো ইচ্ছা করে। সেইরূপ যে-ব্যক্তি এই প্ৰৈষমন্ত্ৰসকলকে দীর্ঘ বলিয়া জানে, সেই ব্যক্তি তাহা ভালো জানে; কেননা এই যে প্ৰৈষমন্ত্ৰসকল, এতদ্দ্বারাই নষ্টযজ্ঞের অন্বেষণ হয়। সেইজন্য (মৈত্রাবরুণ) মাথা নোয়াইয়া দাঁড়াইয়া প্ৰৈষমন্ত্ৰ পাঠ করিবেন।(৬১)
অবশ্য এখানে নষ্ট যজ্ঞের পুনর্গঠন-পদ্ধতি বর্ণিত হলেও আদিকালে যজ্ঞ যে ভক্ষ্য-অন্ন লাভেরই কৌশল ছিলো—সে-কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। কিন্তু অন্যত্র তা বলা হয়েছে :