এই পরিবর্তনের বিভিন্ন স্তরের পরিচয় দেখা যাক। প্ৰথম স্তরে আমরা দেখতে পাই, যজমানের সঙ্গে স্তোতার একটা পার্থক্য ফুটে উঠছে, যে-পার্থক্যের পরিচয় পূর্বোক্ত ঋকগুলিতে চোখে পড়ে না।
প্ৰ হি ক্ৰতুৎ বৃহথে যং বনুথো রধ্রস্য স্থো যজমানন্য চোদৌ।
অর্থাৎ,–(হে ইন্দ্রসোম), দ্বেষকারীকে উত্তমরূপে হিংসা কর, যজমানের শত্রুর প্রতি প্রেরক হও।। ঋগ্বেদ : ২.৩০.৬।।
শাকী ভব যজমানস্য চোদিতা বিশ্বেত্তা তে সধমাদেষু চাকন।
অর্থাৎ, –(হে ইন্দ্র), শক্তিমান হইয়া তুমি যজ্ঞেযুক্ত যজমানের প্রেরয়িতা হও এবং আমিও যজ্ঞে তোমার সমন্ত কর্ম কীর্তন করিতে অভিলাষী। ঋগ্বেদ : ১.৫১.৮।।
এখানে যজমানের সঙ্গে স্তোতার যে-প্ৰভেদ সুচিত হচ্ছে তাই আরো স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখা যায়—
আষাম প্রাঞ্চো যজমানমচ্ছ–
অর্থাৎ, –আমরা যজমানের অভিমুখে আসি। ঋগ্বেদ : ৫.৪৫.৫ ৷৷
সুতংভরো যজমানস্য সৎপতির্বিশ্বাসামুধঃ স ধিয়ামুদঞ্চনঃ।
অর্থাৎ,–পুত্রবর্ধনকারী (ব্যক্তি) যজমানের সর্বপ্রকার শোভন ফলের প্রাপয়িতা।। ঋগ্বেদ : ৫.৪৪.১৩।।
……সবিত্রে যজ্ঞং নয় যজমানায় সাধু।।
অর্থাৎ,–(হে অগ্নি) যজমানের পক্ষে সবিতার উদ্দেশ্যে যজকে বহন কর।। ঋগ্বেদ : ৬.১৫.১৬।।
যজমান কীভাবে যজ্ঞকর্মের বাস্তব দায়িত্ব থেকে সরে যাচ্ছে তা দেখবার জন্যে ঋগ্বেদের ৪.১৭.১৫ ঋকের সঙ্গে ১.২৪.১১ ঋকের ইংগিতকে তুলনা করা যায়। ১.২৪.১১-র দেখি “শাস্তে যজমানঃ হবির্ভিঃ”–যজমান হবিসমূহদ্বারা শাসন করে; অতএব এখানে যজমান আর হোতা অভিন্ন। অথচ, ৪.১৭.১৫-য় দেখা যায়, “অসিক্ন্যাং যজমানো ন হোতা,”–অৰ্থাৎ, অসিক্নীতীরে যজমানই যেন হোতা। এখানে ‘ন’ বা ‘যেন’ শব্দটি বিশেষ চিত্তাকর্ষক; এর থেকে অনুমান করা যায় যে, অসিক্নীতীরে তখনো হোতা ও যজমানের মধ্যে প্ৰভেদ প্রকট হয়নি, অথচ আলোচ্য ঋকের রচয়িতার অভিজ্ঞতায় তা হয়েছে।
ঋত্বিক এবং যজমানের মধ্যেও প্ৰভেদ ফুটে উঠতে দেখা যায় :
কৃধি রত্নং যজমানায় সুক্রতো ত্বং হি রত্নধা অসি।
আ ন ঋতে শিশীহি বিশ্বম্ ঋত্বিজং সুশংসো যশ্চ দক্ষতে।।
অর্থাত,–হে শোভনকর্মযুক্ত (অগ্নি), তুমি রত্নাকর, যজমানকে রত্ন প্রদান কর; আমাদের যজ্ঞে সমস্ত ঋত্বিকগণকে অনুপ্রেরিত কর, যাহাতে শোভন স্তুতি বর্ধিত হয়।। ঋগ্বেদ : ৭.১৬.৬।।
ঋগ্বেদে অধ্বর্যুর উল্লেখও পাওয়া যাচ্ছে এবং যজমানের সঙ্গে তার প্ৰভেদ ঠিক কতোখানি পরিস্ফূট হয়েছে তা বিচার করা দরকার :
শংসাবাধ্বৰ্যো প্ৰতি মে গৃণীহীন্দ্রায় বাহঃ কৃণবাব জূষ্টম।
এদং বহির্যজমানস্য সীদাথা চ ভূদুক্থ্যম্ ইন্দ্ৰায় শস্তম্।।
অর্থাৎ,–অর্ধ্বযু উদ্দেশ্যে শ্ৰীতিযুক্ত স্তব করিব, আমার সহিত চুক্তিবদ্ধ হও, ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে প্রীতিযুক্ত স্তব করিব, যজমানের এই কুশে উপবেশন কর, ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে উক্থ্য প্রশস্ত হউক।। ঋগ্বেদ : ৩.৫৩.৩।।
যজ্ঞকর্মে বাস্তব অংশগ্রহণের দায়িত্ব-মুক্ত হতে হতে শেষ পর্যন্ত যজমান কী ভাবে শুধু নিশ্চেষ্টই নয়, চেতনাহীন ব্যক্তিমাত্রে পরিণত হয়েছিলেন—এই বিষয়টি দেখবার জন্য আমরা এখানে ঋগ্বেদের একটি অর্বাচীনতম ঋক উদ্ধৃত করবো।
যমৃত্বিজো বহুধা কল্পয়ন্তঃ সচেতসো যজ্ঞমিমং বহন্তি।
যো অনূচানো ব্রাহ্মণো যুক্ত আসীৎকা স্বিৎ তত্র যজমানস্য সংবিৎ৷।
অর্থাৎ, –যাঁহাকে বহুরূপে কল্পনা করিয়া ঋত্বিকগণ এই যজ্ঞকে সচেতনভাবে বহন করিয়া থাকেন এবং যিনি বেদবিদ্যাপারঙ্গম ব্ৰাহ্মণদ্বারা যুক্ত (আরাধিত),–সেখানে আর যজমানের চেতনার কী প্রয়োজন?।। ঋগ্বেদ : ৮.৫৮.১।।
এই ঋকটি বালখিল্য সূক্তের অন্তর্গত। অষ্টম মণ্ডলের কয়েকটি সূক্তকে বালখিল্য সূক্ত বলা হয়। অত্যন্ত অর্বাচীন বলেই এগুলির মূল্য কম—সায়ন এগুলির টীকা দেননি। কিন্তু আমন অর্বাচীন বলেই এর সাক্ষ্য আমাদের বর্তমান যুক্তির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ : এখানে যজমানকে যে-ভাবে যজ্ঞ-ব্যাপারে অজ্ঞ ও সম্বিতহীন বলে কল্পনা করা হয়েছে, তার সঙ্গে পূর্বোক্ত ঋকগুলির তুলনা করলে বোঝা যায় যে, যজমানের ভূমিকায় ইতিমধ্যে অনেক তফাত হয়ে গিয়েছে।
আলোচ্য ঋকটির ব্যাখ্যায় আধুনিক বেদ-বিদ্ বলেছেন, “যৎ কর্মনি ঋত্বিগেব সাবধানোহস্তি, তত্ৰ যজমানস্য প্ৰজ্ঞাপাটবেন কিং প্রয়োজনমস্তি? ন কিঞ্চিৎ অপীতি ভাবঃ” ।
সংক্ষেপে : যজমান শব্দের ইতিহাস বিশেষ চিত্তাকর্ষক। এর থেকে বৈদিক যজ্ঞের ইতিহাস এবং এমনকি বৈদিক মানুষদের সমাজ-ইতিহাসেরও আভাস পাওয়া যেতে পারে। আমরা অনুমান করবার চেষ্টা করেছি, আদিতে যজ্ঞ বলতে যৌথ-অনুষ্ঠান বোঝাতো। যাঁরা যজ্ঞফলাভিলাষী তাঁরা—যজমানেরা–নিজেরাই যজ্ঞ-কর্মে অংশগ্ৰহণ করতেন। যজমান শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থের মধ্যে এ-ইংগিত পাওয়া যায় এবং ঋগ্বেদের অংশবিশেষে যজমান শব্দের বাস্তব প্রয়োগ এই ইংগিতটিকেই সমর্থন করে। এই প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য হলো, যজমান শব্দের বহুবচনে প্ৰয়োগ। অতএব এই সাক্ষ্যগুলিকে আমরা বৈদিক মানুষদের সমাজ-জীবনের প্রাক-বিভক্ত পৰ্যায়ের স্মারক বলে সনাক্ত করবার চেষ্টা করেছি। কেননা, প্ৰাক-বিভক্ত পর্যায়ে শ্রম বা উৎপাদন-কর্ম একান্তই যৌথ যদিও অবশ্যই তা জাদু-অনুষ্ঠান বা ritual-এর সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। কালক্রমে পৃথিবীর অন্যান্য মানবজাতির মতোই বৈদিক মানুষদেরও প্রাক্-বিভক্ত প্রাচীন সমাজ-সংগঠন ভেঙে যায় এবং তারই ফলে যজ্ঞ ও যজমান শব্দের আদি-তাৎপৰ্যও পরিবর্তিত হয়। শেষ পর্যন্ত আমরা দেখি যজমান বলতে একরকম বিত্তশালী ব্যক্তিকেই বোঝানো হচ্ছে–যজ্ঞ বিষয়ে তাঁর নিজের কোনো জ্ঞান বা চেতনার প্রয়োজন নেই, কেননা তিনি যজ্ঞে অংশগ্রহণ করবার দায়িত্ব-মুক্ত—তাঁর হয়ে যজ্ঞ করে দেবার জন্য অর্থব্যয় করে পেশাদার পুরোহিত নিয়োগ করেই তিনি ক্ষান্ত।