এ বা নৃভিরিন্দ্রঃ সুশ্রবস্যা প্রখাদঃ পৃক্ষো অভিমিত্রিণো ভূৎ।
সমৰ্য ইষঃ স্তবতে বিবাচি সত্ৰাকরে যজমানস্য শংসঃ॥
অর্থাৎ,–(ইন্দ্র) কর্মনির্বাহক নবরূপ যজমানগণ কর্তৃক প্রদত্ত হবিযুক্ত অন্ন শোভন অন্নের ইচ্ছায় ভক্ষন করেন; মিত্রযুক্ত যজমানের জন্য বিবিধ কোলাহলযুক্ত সংগ্রামে তাহার প্রশংসা করিয়া মঙ্গলবিধান করেন।। ঋগ্বেদ : ১.১৭৮.৪ ৷৷
দ্রষ্টব্য হলো, যজমান এখানে ব্যক্তিবিশেষ নন; মিত্রযুক্ত ও বহু। তাঁরা নিজেরাই সমবেতভাবে হবিযুক্ত অন্ন প্ৰদান করছেন এবং মঙ্গললাভ করছেন–যজ্ঞ-ফল অভিলাষী কোনো এক যজমানের দ্বারা অর্থবিনিময়ে নিযুক্ত হয়ে ঋত্বিকেরা যজ্ঞ করে দিচ্ছেন না। এই প্রসঙ্গেই মনে রাখা যায় যে, ঋগ্বেদে সাধারণ-হবি বা common oblation-এর উল্লেখ পাওয়া যায় : “তদিৎ সমানমাশাতে বেনন্ত ন প্ৰ যুচ্ছতঃ ধৃতব্ৰতায় দাশুষে”—তাঁহারা দুইজন (মিত্র ও বরুণ) সেই সাধারণ (হবি) ভক্ষণ করেন, তাঁহারা অভিলাষযুক্ত হইয়া দানশীল ব্রতধারীকে সিদ্ধমনস্কাম করেন (ঋগ্বেদ : ১.২৫.৬)।
ঋগ্বেদে বহুবচনে এবং নিজেরাই যজ্ঞ-সম্পাদনকারী অর্থে যজমান শব্দের ব্যবহার বিরল নয় :
যদিষ্ঠং ত্বা যজমানা হুবেম জ্যোষ্ঠমঙ্গিরসাং
বিপ্র মন্মভির্বিপ্রেভিঃ শুক্র মন্মভিঃ।
পরিজমানমিব দ্যাং হোতারং চর্ষণীনাম্।
শোচিষ্কেশং বৃষণং যামিমা বিশঃ প্রাবস্তু ভূতয়ে বিশঃ।।
অর্থাৎ,–যজনীয়দিগের শ্রেষ্ঠ তোমাকে (অগ্নিকে) আমরা যজমানগণ আহ্বান করি,–হে অঙ্গিরাগণের জ্যেষ্ঠ বিপ্র, জ্বালাময় জনন ও মন্ত্রসমূহের দ্বারা, সূর্যের ন্যায় চতুর্দিকে গমনকারী, হে মনুষ্যদিগের মুখপাত্ৰ, তোমাকে সেই স্বর্গে প্রবেশকামী যজমানগণ প্রীত করুক, হে জ্বালাময় কেশযুক্ত (অগ্নি)।। ঋগ্বেদ : ১.১২৭.২।।
ঈলে চ ত্বা যজমানো হবির্ভিরীলে সখিত্বং সুমতিং নিকামঃ।।
অর্থাৎ, –তোমাকে (অগ্নিকে) যজমানগণ হবিসমূহের দ্বারা স্তব করে এবং সুমতির অভিলাষ করিয়া তোমার সখিত্বের জন্য স্তব করে।। ঋগ্বেদ : ৩.১.১৫।।
মা তে হরী বৃষণা বীতপৃষ্ঠা নি রীরমন্ যজমানাসো অন্যে।
অত্যায়াহি শশ্বতো বয়ং তে অরং সুতেভিঃ কৃণবাম সোমৈঃ।।
অর্থাৎ, –তোমার (ইন্দ্রের) কোমল পৃষ্ঠযুক্ত অশ্ব দুইটি অন্য যজমানদিগের প্রীতির কারণ যেন না হয়; তাহাদের অতিক্রম করিয়া তুমি আগমন কর, আমরা তোমার রথের অরদণ্ডগুলিকে অভিসূত সোমের দ্বারা মসৃণ করিয়া দিব।। ঋগ্বেদ : ৩.৩৫.৫।।
আসানেভির্ষজমানো মিয়েধৈর্দেবানং জন্ম বসুয়ূর্ব্ববন্দ।।
অর্থাৎ,–যজ্ঞফললাভার্থ উপবিষ্ট ব্যক্তিগণের সহিত যজমান ধনকামনায় দেববৃন্দকে বন্দনা করিয়াছিলেন।। ঋগ্বেদ : ৬.৫১.১২ ৷।
রায়স্পোষং যজমানেষু ধত্তম।।
অর্থাৎ, –(হে ইন্দ্রাবরণ), যজমানদিগের ধন বর্ধিত কর। ঋগ্বেদ : ৮.৫৯.৭ ৷৷
রায়স্পোষং যজমানেষু ধারয়।।
অর্থাৎ,–(হে অগ্নি), যজমানদিগের ধন বর্ধিত কর। ঋগ্বেদ ; ১০.১২২.৮ ৷৷
উত্তরকালের সাহিত্যে যজ্ঞের যে-রূপটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় সেখানে দেখা যায় হবি-প্রদান, সোমসবন প্রভৃতি কাজ যজমান-নিযুক্ত ঋত্বিক-বিশেষেরই দায়িত্ব; যজমানের দায়িত্ব নয়। কিন্তু পুরাকালে এ-জাতীয় কাজ যে-যজমানদেরই ছিলো,–অর্থাৎ, যজমানেরা নিজেরাই যে যজ্ঞে অংশগ্ৰহণ করতেন,–সে-কথা ঋগ্বেদ-রচনার যুগেও বৈদিক ঋষিদের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি।
শান্তে যজমানঃ হবির্ভিঃ।
অর্থাৎ, –যজমান হবিসমূহদ্বারা শাসন করেন।। ঋগ্বেদ : ১.২৪.১১।।
যজমানায় শিক্ষসি সুন্বতে ভূরি তে বসু।
অর্থাৎ,–(হে ইন্দ্র), তুমি সোমসবনকারী যজমানকে তোমার প্রভৃত ধনসম্পদে শিক্ষা দিয়া থাক।। ঋগ্বেদ : ১.৮১.২।।
ভদ্রা শক্তিঃ যজমানায় সুন্বতে।
অর্থাৎ,–সোমসবনকারী যজমানকে মঙ্গলময় শক্তি ( প্ৰদান করেন ) ।। ঋগ্বেদ : ১.৮৩.৩।।
সুকৃতে সুদানবে বিশ্বেদহ যজমানায় সুন্বতে।
অর্থাৎ,–শোভনকর্মকারী দানশীল সোমসবনকারী যজমানকে…।। ঋগ্বেদ : ১.৯২.৩ ৷৷
পূষন্ননু প্র গা ইহি যজমানস্য সূন্বতঃ অস্মাকং স্তবতামূত।
অর্থাৎ,–হে পুষণ, সোমসবনকারী যজমানের গরুগুলির অনুগমন কর; স্তবকারী আমাদের (গরুগুলির অনুগমন কর)।। ঋগ্বেদ : ৬.৫৪.৬।।
ইন্দ্ৰাগ্নী শৃণুতং হবং যজমানস্য সুন্বতঃ।
অর্থাৎ,–হে ইন্দ্র-অগ্নি, সেবনকারী যজমানদের আহ্বান শ্রবণ কর।। ঋগ্বেদ : ৬.৬০.১৫।।
সুন্বতো বৃধো যজমানস্য সৎপতে
অর্থাৎ,–সোমসবনকারী যজমানের মঙ্গলকারী ও বর্ধক। ঋগ্বেদ : ৮.১২.১৮ ৷৷
ধেনুষ্ট ইন্দ্ৰ সুনৃতা যজমানায় সুন্বতে গামশ্বং পিপ্যুষী দুহে।
অর্থাৎ, –হে ইন্দ্ৰ, তোমার স্তুতিরূপ বাক্য গাভীরূপে, সোমসবনকারী যজমানকে গরু, অশ্ব দোহনদ্বারা সমৃদ্ধ করায়।।ঋগ্বেদ : ৮.১৪.৩।।
অবশ্যই বৈদিক সাহিত্য সুদীর্ঘ যুগের রচনা। আমরা আগেই বলেছি, এক ঋগ্বেদ-সংহিতার প্রাচীনতম ও অর্বাচীনতম অংশের মধ্যে সময়ের ব্যবধান দ্বিসহস্ৰাধিক বছর হতে পারে। অতএব, এই ঋগ্বেদ সংহিতার আগাগোড়াই–সমস্ত ঋকেই–যে একই রকম সমাজবাস্তব প্রতিফলিত হবে, তা কল্পনা করা যুক্তিবিরুদ্ধ। এবং বাস্তবভাবেও দেখা যায় যে, তা নয়। এই ঋগ্বেদ-সংহিতার মধ্যেই চোখে পড়ে, যজ্ঞে যজমানের ভূমিকায় পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে এবং তারই ফলে যজমান শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ও এমন কি অজ্ঞ অভিলাষী-মাত্রে পরিণত হচ্ছে : তখন শুধু যজ্ঞের ফলাটাই তার, কিন্তু যজ্ঞকর্মে তার কোনো অবদান নেই।