অবশ্যই আমাদের পক্ষে এখানে সে-আলোচনার সুযোগ বা প্রাসঙ্গিকতা নেই। কেননা আমাদের যুক্তির পক্ষে তা প্রয়োজন নয়। আমাদের যুক্তির পক্ষে এখানে শুধু এটুকু প্ৰতিপন্ন করবার প্রচেষ্টাই পৰ্যাপ্ত যে, বৈদিক সমাজের মতোই বৈদিক অনুষ্ঠানগুলিরও একটা ইতিহাস আছে। উত্তরকালের সাহিত্যে আমরা বৈদিক যজ্ঞের যে-রূপ দেখছি, তাই যজ্ঞের আদিরূপ নয় এবং এই রূপ-পরিবর্তন বলতে শুধুমাত্র এটুকু বোঝায় না যে, কালক্রমে যজ্ঞ অত্যন্ত জটিল ও পল্লবিত হয়েছিল; তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, পরবর্তীকালে যজ্ঞের উদ্দেশ্য এবং চরিত্রও মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। আমাদের প্রতিপাদ্য হবে, অধ্যাত্মবাদের আবির্ভাব এই মৌলিক পরিবর্তনেরই পরিণাম ।
আমরা প্ৰথমে এ-বিষয়ে যজমান শব্দটির সাক্ষ্য গ্ৰহণ করবো, কেননা এই শব্দটির পিছনে একটা ইতিহাসের ইংগিত আছে। যজমান শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ এবং বাস্তব অর্থের মধ্যে যে-বিরোধ, তা থেকেই ওই ইংগিত পাওয়া যায়।
মনিয়ার উইলিয়াম্স্(৫৮) বলছেন, যজমান শব্দের অর্থ হলো,
The person paying the cost of a sacrifice, the institutor of a sacrifice who, to perform it, employs a priest or priests, who are often hereditary functionaries in a family), any patron, host, rich man, …
অর্থাৎ, যিনি নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যজ্ঞসম্পাদন করান। দ্রষ্টব্য হলো, যজ্ঞ-সম্পাদনের দায়িত্ব যজ্ঞীয় পুরোহিতদের বা ঋত্বিকদের উপর, যজমান নিজে যজ্ঞকৰ্ম করেন না। যজ্ঞ-ফল কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তারই ; এবং তার হয়ে যজ্ঞ করে দেবার জন্য তিনি ওই পুরোহিতদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দান করেন। এই কারণেই যজমান ধনী ও বিত্তশালী patron, host, rich man।
বলাই বাহুল্য, উত্তরকালের সাহিত্যে আমরা যজমান শব্দটিকে এই অর্থেই নিযুক্ত হতে দেখি। উদাহরণ-স্বরূপ আমরা এখানে ছান্দোগ্য-উপনিষদ(৫৯) থেকে একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে পারি।
কুরুদেশ শিলাবৃষ্টিতে বিনষ্ট হইলে ঊষন্তি চাক্রায়ণ…অত্যন্ত দুর্দশা প্রাপ্ত হইয়া ইভ্য-গ্রামে বাস করিতেছিলেন।…পরদিবস প্রাতঃকালে ঊষন্তি নিদ্রাত্যাগ করিয়া স্ত্রীকে বলিলেন, “হায়, যদি কিঞ্চিত অন্ন পাইতাম, কিছু অর্থলাভ হইত। ঐ রাজা যজ্ঞ করিবেন; ঋত্বিকগণের সমুদয় কাৰ্য সম্পাদনের জন্য তিনি আমাকে বরণ করিতে পারিতেন”। (জায়া তাঁহাকে পূর্বদিবসের ভূক্তাবশিষ্ট কূল্মাষ দিলেন এবং তাহা ভক্ষণ করিয়া তিনি সেই প্রারব্ধ যজ্ঞে গমন করিলেন এবং ঘোষণা করিলেন যে, ইতিমধ্যে যে-ঋত্বিকগণ যজ্ঞসম্পাদন আরম্ভ করিয়াছেন তাহারা অনধিকারী)।… অনন্তর যজমান তাঁহাকে বলিলেন, “আমি আপনাকে জানিতে ইচ্ছা করি।” ঊষন্তি বলিলেন, “এই সমুদয় ঋত্বিক-কর্মের জন্য আমি সর্বত্র আপনার অন্বেষণ করিয়াছিলাম। আপনার সন্ধান পাই নাই বলিয়াই অন্য সমুদয় লোককে বরণ করিয়াছি। আপনিই আমার সমুদয় ঋত্বিক-কার্যের ভার গ্রহণ করুন”। ঊষন্তি বলিলেন, “তাহাই হউক। এখন ইয়াহ্রাই আমার অনুমতিতে স্তুতিগান করুক। আপনি ইহাদিগকে যে-পরিমাণ অর্থ দিবেন। আমাকেও সেই পরিমাণ অর্থ দিবেন”। যাজমান বলিলেন, “তাহাই হইবে” ।
অবশ্যই, পরবর্তী সাহিত্যে যজমান শব্দটিকে আমরা এই অর্থেই প্ৰযুক্ত হতে দেখি : ঋত্বিকদের তিনি অর্থ দেবেন এবং এই পারিশ্রমিকের বিনিময়েই ঋত্বিকেরা তার হয়ে যজ্ঞ-সম্পাদন করে দেবেন।
কিন্তু আমরা যে-অর্থে বৈদিক যজ্ঞের আদিরূপ বোঝবার চেষ্টা করছি তার সঙ্গে যজমান শব্দের এ-তাৎপর্যের সঙ্গতি নেই। কেননা, যজ্ঞ বলতে আদিতে যদি প্ৰাচীন সমাজের অনুষ্ঠান-নির্ভর উৎপাদন-ক্রিয়াই বুঝিয়ে থাকে, তাহলে তা অনিবাৰ্যভাবেই যৌথকর্মপদ্ধতি হতে বাধ্য। অর্থাৎ, স্বয়ং যজমানের পক্ষে তাতে অংশগ্ৰহণ করা প্ৰয়োজন।
অতএব, যজ্ঞ-প্রসঙ্গে আমাদের কাছে একটি প্ৰধান প্রশ্ন এই হয়েছে যে, উত্তরকালে যজমান শব্দের তাৎপৰ্য যাই হোক না কেন, আদিতে তার স্বতন্ত্র কোনো তাৎপৰ্য ছিলো কিনা; এবং যদি তা থাকে তাহলে সেই স্বতন্ত্র তাৎপর্যের মধ্যে আমরা এমন কোনো ইংগিত পাই কিনা যা থেকে অনুমান করা সম্ভব যে, এককালে স্বয়ং যজমানেও যজ্ঞে অংশগ্ৰহণ করতেন?
এই প্রশ্নের উত্তর পাবার আশায় আমরা প্ৰথম যজমান শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ বিচার করবার চেষ্টা করেছি।
যজ্+শানচ্=যজমান। এখানে আত্মনেপদ (শানচ্) ব্যবহৃত হয়েছে। এবং ব্যাকরণের নিয়ম হলো, ক্রিয়াপদের ফল যখন কর্তার অভিপ্রায় সিদ্ধ করে তখন ধাতুর আত্মনেপদ হয় এবং অতএব, আত্মনেপদ ব্যবহৃত হয় : “স্বরিতাঞিতঃ কর্ত্রভিপ্ৰায়ে ক্রিয়াফলে”।
তাহলে, বুৎপত্তির দিক থেকে যজমান শব্দের অর্থ হলো, যিনি নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য যজ্ঞকৰ্ম করেন। যজমান শব্দটিকে আমরা বাস্তবভাবে যে-অর্থে নিযুক্ত হতে দেখি তার সঙ্গে এর তফাত কোথায়? সেখানেও যজমানই যজ্ঞফলভোগী; কিন্তু তিনি স্বয়ং যজ্ঞকর্মে অংশ গ্রহণ করছেন না–তার বদলে অর্থব্যয় করে যজ্ঞ-সম্পাদনকারী নিযুক্ত করছেন।
আমরা নিশ্চয়ই আশা করতে পারি যে, ওই বুৎপত্তিগত অর্থের মধ্যেই যজমান শব্দের আদি-তাৎপর্যের পরিচয় পাওয়া যাবে এবং ঋগ্বেদ যেহেতু বৈদিক মানুষদের প্রাচীনতম সাহিত্য-নিদর্শন সেইহেতু ঋগ্বেদে যজমান শব্দের ওই আদি-অর্থে ব্যবহার খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হওয়া উচিত নয়। অতএব আমরা প্রশ্ন তুলেছি, অর্থব্যয় করে ঋত্বিক নিয়োগের পরিবর্তে নিজে যজ্ঞ করছেন—এই অর্থে ঋগ্বেদে যজমান শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায় কি?