হরিভদ্র ছিলেন অনুমানিক খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর জৈন লেখক। তাঁর লেখা ষড়দর্শনসমুচ্চয়-এর উল্লেখ প্রথম পরিচ্ছেদে করা হয়েছে। এ-বইতে তিনি লোকায়তমতের ব্যাখায় করেছেন এবং সেই প্রসঙ্গেই তাঁর টীকাকার গুণরত্ন লোকায়তিকদের সম্বন্ধে অনেক কিছু বিস্ময়কর তথ্য দিয়েছেন। অবশ্যই, মহামহোমাধ্যায় তাঁর প্রবন্ধে গুণরত্নের কথাগুলি বিস্তৃত বিবরণ বা বিশ্লেষণ দেন নি। সে-আলোচনায় আমরা পরে ফিরবো। আপাতত, গুণরত্নের মন্তব্যের ঠিক যতোটুকু মহামহোমাধ্যায় নিজে উল্লেখ করেছেন ততোটুকুর উপরই দৃষ্টি নিবন্ধ রাখা যাক।
মহামহোমাধ্যায় বলছেন, যদিও বৃহস্পতির রচনায় লোকায়তিক ও কাপালিকদের কথা স্বতন্ত্র ভাবে উল্লেখিত হয়েছে তবুও গুণরত্নের মতে এ-দু’-এর মধ্যে কোনোই তফাত নেই(১০)। মহামহোপাধ্যায়ের হিসেবে গুণরত্ন ছিলেন খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর লেখক। এবং মহামহোপাধ্যায় বলছেন, তাঁর লেখা পড়লে স্পষ্টই বোঝা যায় যে তাঁর সময়েও লোকায়তিক সম্প্রদায় দেশ থেকে বিলুপ্ত হয় নি। কথাটি বিশেষ করে উল্লেখ করলাম এই কারণে যে মহামহোপাধ্যায়ের নিজের লেখা সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ, তাঁর ধারণায় তাঁর নিজের যুগেও অন্তত বাংলা দেশে নামান্তরের আড়ালে লোকায়তিকের দল সত্যিই টিকে রয়েছে। এই চিত্তাকর্ষক ও গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যের আলোচনায় আমরা একটু পরেই ফিরবো। আপাতত, কাপালিকদের কথাটা ভালো করে দেখে নেওয়া যাক। কেননা, গুণরত্ন লোকায়তিকদের সঙ্গে এদের অভিন্নতা উল্লেখ করেই ক্ষান্ত নন, লোকায়তিকদের এমন বর্ণনা দিচ্ছেন যা ওই কাপালিকদের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায় : লোকায়তিকেরা নাকি গায়ে ভস্ম মাখে, মদ খায়, মাংস খায়, তারা মৈথুনাশক্ত ও যোগী(১১)।
সর্বশেষ বিশেষণটি সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক। লোকায়তিকদের সম্বন্ধে আমাদের যেটুকু সাধারণ ধারণা তার সঙ্গে আর যাই হোক যোগী শব্দটা কিছুতেই খাপ খায় না। অথচ পুঁথিতে লেখা রয়েছে,—কথাটাকে তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়াও চলবে না! তাহলে পুঁথিতে যা লেখা রয়েছে তাকে গুরুত্ব দিতে হলে শুধু লোকায়ত নয়, ‘যোগী’ সম্বন্ধেও আমাদের সাধারণ ধারণাকে শুধরে নেবার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু শুধরে যে নেবো তা তো দলিল-দস্তাবেজের উপর নির্ভর করেই। অবশ্যই, দলিলের অভাব নেই। আমরা যতোই অগ্রসর হবো ততোই দেখতে পাবো ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে বহুদিন ধরে প্রচলিত আমাদের সাধারণ ধারণার সঙ্গে খাপ-খায় না এমনতরো দলিল রয়েছে রাশি রাশি। কিন্তু শুধু দলিল থাকলেই হয় না। দলিলগুলির প্রকৃত অর্থ নির্ণয় করার জন্যে একটা কোনো অভ্রান্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিরও প্রয়োজন। আমি বলতে চাই, সে-পদ্ধতির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে অধ্যাপক জর্জ টম্সনের গ্রন্থাবলী থেকে। উক্ত পদ্ধতির সাহায্যে লোকায়ত ও যোগী উভয় শব্দকেই কী রকম নতুন আলোয় দেখা সম্বব তার আলোচনা পরে তুলবো। আপাতত, শুধু এইটুকুই দেখাতে চাইছি যে ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে আমাদের সাধারণ যে সব ধারণা তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা কোনো কাজের কথা নয়। কেননা, তাহলে ভারতীয় দর্শনের পুঁথিপত্রগুলিতেই যা লেখা আছে তাও অস্বীকার করা দরকার।
————————
৭. D. R. Shastri SMIMSH
৮. H. P. Shastri op. cit. 5.
৯. এই গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদের চতুর্থ পাদটীকা দ্রষ্টব্য।
১০. H. P. Shastri op. cit. 6.
১১. এই গ্রন্থের ৪৩৫-৬ পৃষ্ঠ দ্রষ্টব্য [“লোকায়তিক ধ্যানধারণার উৎস-প্রসঙ্গে : অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত]
০৩. লোকায়ত ও কাপালিক
যোগীর কথা ছেড়ে দিলেও কাপালিক নামটিকেই দেখুন না। প্রাচীনেরা বলছেন, লোকায়ত আর কাপালিক একই কথা। কিন্তু আমাদের মনে কাপালিক ও লোকায়ত সম্বন্ধে যেটুকু সাধারণ ধারণা তার সঙ্গে এ-কথার কোনো রকম সঙ্গতি কি খুঁজে পাওয়া যায়?
লোকায়তিকদের সম্বন্ধে আমাদের যেটুকু সাধারণ ধারণা তার প্রায় চোদ্দ আনাই মাধবাচার্যের লেখা সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ থেকে সংগৃহীত। এই বইতে লেখা আছে, লোকায়তিকেরা অনুমান মানে না, আত্মা মানে না, পরলোক মানে না, ঈশ্বর মানে না। তার বদলে তারা মনে করে প্রত্যক্ষই হলো একমাত্র প্রমাণ, দেহই আত্ময়া, ইহলোকই সব, সুখভোগ ছাড়া কোনো পুরুষার্থ নেই। মাধবাচার্যের এই লেখা থেকে লোকায়তিকদের সম্বন্ধে একটা ধারণা হয়। কিন্তু তার সঙ্গে কাপালিক-সংক্রান্ত ধারণার যোগাযোগ কোথায়? অবশ্যই, কাপালিক সম্বন্ধে আমাদের ধারণাটুকু সত্যিই খুব স্পষ্ট নয়—যেটুক স্পষ্ট তা শুধুমাত্র ভয়াবহ বীভৎসতার একটা ছবি। চীন পর্যটক হুয়েন্সাঙ(১২) ভারতবর্ষে বহু কাপালিক দেখেছিলেন—তাদের গলায় মড়ার খুলির মালা, মড়ার খুলি ভরে তারা মদ খায়। হুয়েন্সাঙ-এর ঢের আগেই বরাহমিহির(১৩) (ষষ্ঠ শতাব্দীতে) তাঁর বৃহৎসংহিতায় কাপালিকদের কথা যেটুকু উল্লেখ করেছেন তার থেকে এর চেয়ে স্পষ্ট আর কোনো ছবি পাওয়া যায় না। অবশ্যই, কাপালিক সম্বন্ধে আমাদের চলতি ধারণাটা প্রধানতই নাটক-নভেল থেকে পাওয়া। বঙ্কিমচন্ত্রের কপালকুণ্ডলা(১৩) মনে আছে? মনে আছে, কাপালিকদের সেই নিষ্ঠুর বীভৎসতার চিত্র? কাপালিকদের সম্বন্ধে এই রকম ঘৃণার ভাব শুধুই বঙ্কিমচন্দ্রের নভেল-এ নয়; তাঁর ঢের আগেকার যুগের নাটকেও। একাদশ শতাব্দীতে লেখা কৃষ্ণমিশ্রের(১৫) প্রবোধচন্দ্রোদয়-এ দেখতে পাই একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ও একজন দিগম্বর জৈন সাধুর সংযম পরীক্ষা করবার জন্যে এক কাপালিক আর এক কাপালিকার চরিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে; অবশ্যই, তাদের স্বভাবচরিত্রের কোনো বালাই নেই—তাই মঞ্চের উপরেই তারা কামসাধনা শুরু করে দিলো! তারও আগে, সম্ভবট খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে লেখা ভবভূতির মালতীমাধব(১৬) নাটকে দেখা যায় নায়িকা মালতীকে প্রলুব্ধ করার, এবং শেষ পর্যন্ত তার সর্বনাশ সাধন করার, দায়িত্ব এক কাপালিকার উপরই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই জাতীয় নাটক-নভেল পড়েশুনে কাপালিকদের সম্বন্ধে আমাদের মনে কোনো রকম স্পষ্ট ধারণা হোক আর নাই হোক অন্তত একটা তীব্র ঘৃণা বিদ্বেষের ভাব যে জন্মায় সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্যই, লোকায়তিকদের সম্বন্ধেও যেটুকু খাপছাড়া খবর পাওয়া যায় তার মধ্যেও বিদ্বেষের ভাবটা খুবই প্রকট। দার্শনিক পুঁথিপত্রের কথা ছাড়াও এমনকি দেশের খোদ আইনকার্তা বিধান দিয়েছেন, সাধু-সমাজ থেকে লোকায়তিকদের দূর করে দিতে হবে। কিন্তু শুধু সেই কারণেই,—দুই-এর বিরুদ্ধেই বিদ্বেষের ভাব রয়েছে বলেই,—লোকায়ত ও কাপালিক যে এক এ-কথা বলাও বুদ্ধিমানের লক্ষণ হবে না।