বলাই বাহুল্য, লোকায়ত-দর্শনের এই আলোচনায় যদি কোনো ভুল-ভ্রান্তি ঘটে থাকে তাহলেই প্রমাণ হবে না পদ্ধতিটি ভ্রান্ত। কেননা, পদ্ধতি ফলপ্রসূতা ছাড়াও প্রয়োগ-পটুত্বের কথা রয়েছে। তবু, আত্মশক্তি সম্বন্ধে মনে কোনো মোহকে প্রশ্রয় না দিয়েও এটুকু ভেবেছি যে, ভুলের ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকলে আমরা কোনোদিনই সত্যে পৌঁছতে পারবো না। এ-বিষয়ে অধ্যাপক টম্সনেরই একটি উক্তি(৫) মনে পড়ে :
We cannot reach truth unless we risk error.
হঠকারিতার বরাভয় নয়, অম্বেষীর কাছে আশ্বাসবাণী।
অধ্যাপক টম্সনের পদ্ধতিটি ঠিক কী এই পরিচ্ছেদে তার পরিচয় দিতে চাই। তার আগে দেখা দরকার লোকায়ত-দর্শন প্রসঙ্গে সত্যিই এমন সমস্যা ওঠে যার সমাধান পাবার জন্যে একটি কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োজন আছে।
————————-
১. C. Caudwell IL.
২. F. Engels OFPPS.
৩. H. L. Morgan AS.
৪. G. Thomson AA এবং SAGS.
৫. G. Thomson SAGS 36.
০২. লোকায়ত-প্রসঙ্গে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
লোকায়তিকদের নিয়ে কী এমন সমস্যা উঠছে যে সমাধানের খোঁজে এইভাবে কালাপানি পার হতে হবে?
আমাদের যুগের একজন শ্রেষ্ঠ ভারততত্ত্ববিদের রচনা থেকেই আলোচনা শুরু করা যাক।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘লোকায়ত’ নামে ইংরেজীতে একটি ছোট্ট প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ১৯২৫-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রবন্ধটি স্বতন্ত্র পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধে তিনি প্রাচীন পুঁথিপত্র থেকে লোকায়তিকদের সম্বন্ধে এমন কয়েকটি উক্তি সংগ্রহ করেন যার সঙ্গে লোকায়ত-দর্শন সংক্রান্ত আমাদের সাধারণ ধারণার সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। এ-জাতীয় তথ্য তাই ভারতীয় দর্শনের ছাত্রের কাছে সমস্যা সৃষ্টি না করে পারে না। আপাতদৃষ্টিতে হয়তো সে-সমস্যাকে তুচ্ছ মনে হবে; কিন্তু ভেবে দেখলে দেখা যায়, তা নয়।
সমস্যা যে ওঠে এ-বিষয়ে তিনি নিজেও সচেতন। বস্তুত, সে-সমস্যার সমাধান দেবার চেষ্টা তিনি নিজেই করেছেন। তাছাড়া, তাঁর ওই ছোট্ট পুস্তিকাটির ভিত্তিতেই শ্রীযুক্ত দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী ‘ভারতীয় বস্তুবাদ, ইন্দ্রিয়ানুভূতিবাদ ও ভোগবাদ’(৭) নামের ইংরেজী বইতে লোকায়তিকদের সম্বন্ধে কিছু কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু একটুখানি এদিক-ওদিক তাকালেই,—অর্থাৎ কিনা, ভারতবর্ষের অন্যান্য কিছুকিছু প্রাচীন পুঁথিপত্রের সাক্ষ্য গ্রহণ করলেই,—বোঝা যায় এ-জাতীয় সিদ্ধান্ত জিজ্ঞাসু মনকে সত্যিই সন্তুষ্ট করতে পারে না। সমাধান হিসাবে স্বীকৃত হওয়ার বদলে এ-জাতীয় সিদ্ধান্ত কিছু কিছু নতুন সমস্যারই সৃষ্টি করে।
মহামহোপাধ্যায় লোকায়তিকদের সম্বন্ধে কী রকম তথ্য সংগ্রহ করেছেন? তার থেকে কোন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়? সে-সমস্যার সমাধান হিসাবে তিনি, বা তাঁকে অনুসরণ করে শ্রীযুক্ত দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী, যা বলেছেন তা কেন সন্তোষজনক মনে হয় না?
তথ্যগুলির বর্ণনা থেকেই শুরু করা যাক।
প্রথমত, বার্হস্পত্যসূত্রম্-এর(৮) সাক্ষ্য। স্বয়ং বৃহস্পতির নামের সংগে জড়িত এই পুঁথিটির সঙ্গে আধুনিক পণ্ডিতমহলের পরিচয় খুব বেশি দিনকার নয়। সম্প্রতি কালে ডক্টর এফ. ডব্লিউ. টমাস এটি সংগ্রহ করেন এবং তাঁরই লেখা দীর্ঘ ভূমিকা ও ইংরেজী তর্জমা সম্বলিত হয়ে ১৯২১-এ পাঞ্জাব থেকে এটি প্রথম ছাপানো হয়। ভূমিকায় ডক্টর টমাস আলোচনা করেছেন, পুঁথিটিকে যে-অবস্থায় আমরা পাচ্ছি তার কোনো কোনো অংশ যেমনই প্রাচীন আবার কোনো কোনো অংশ তেমনি অর্বাচীন। ডক্টর টমাসের মতে, প্রাচীনতম অংশগুলিতে লোকায়ত-দর্শনের আদি ও অকৃত্রিম রূপটি খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু মহামহোপাধ্যায় বলছেন, পুঁথিটির যে-অংশগুলিকে ডক্টর অর্বাচীন মনে করেন তার সাক্ষ্যও কম মূল্যবান নয়।
এখানে পুঁথিটির স্তর-বিচার করবার চেষ্টা করলে আলোচনা অনেকখানি বিক্ষিপ্ত হবার সম্ভাবনা। তাই, সে-আলোচনা মূলতবী রেখে দেখা যাক, পুঁথিটির ঠিক কোন সাক্ষ্যের দিকে মহামহোপাধ্যায় আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান।
এই পুঁথির দ্বিতীয় অধ্যায়ে পরের পর দুটি সূত্রে,—তাই মহামহোপাধ্যায়ের ভাষায়, যেন এক-নিশ্বাসে,—লোকায়তিক এবং কপালিকদের সম্বন্ধে দুটি কথা বলা হয়েছে :
সর্বথা লোকায়তিকমেব শাস্ত্রমর্থসাধনকালে।।২।।৫
কাপালিকমেব কাম সাধনে।।২।।৬
–অর্থাৎ, অর্থসাধনকালে সর্বত্র লোকায়তিকই হলো শাস্ত্র, কামসাধনে সর্বত্র কাপালিকই শাস্ত্র।
মহামহোমাধ্যায় বলছেন, এই ভাবে এক-নিশ্বাসে দুটি কথা বলা থেকেই বোঝা যায় কথা দুটি আলাদা নয়। অর্থাৎ, লোকায়তিক ও কাপালিক আলাদা নয়। তাঁর এই উক্তির পক্ষে অবশ্যই আরো একটি যুক্তি দেখানো যায়। তাঁর এই উক্তির পক্ষে অবশ্যই স্বীকার করেন যে কামসাধনার শাস্ত্র বলতে একমাত্র কাপালিকই, তাহলে তাঁর পক্ষে লোকায়তিকদের সঙ্গে কাপালিকদের কোনো বড়ো রকমের তফাত স্বীকার করা সম্ভব হবে না। কেননা, মাধবাচার্য প্রমূখ সমস্ত লেখকদের মতেই, লোকায়তিকেরা পুরুষার্থ বলতে স্বীকার করেন শুধু অর্থ এবং কাম(৯)। আর, যদি তাই হয় তাহলে কাপালিক বা কামসাধনশাস্ত্র লোকায়তের সঙ্গে অভিন্ন হবারই কথা।
কিন্তু লোকায়তের সঙ্গে কাপালিকদের অভিন্নতা প্রমাণ করবার জন্যে বৃহস্পতি-সূত্রের সাক্ষ্যই একমাত্র নয়। শাস্ত্রী মহাশয় আরো একটি সাক্ষ্যের কথা তুলছেন এবং এই দ্বিতীয় সাক্ষ্যের সনতারিখ সম্বন্ধেও স্পষ্ট মত ব্যক্ত করছেন।