প্রথমত, অবশ্যই ধর্মের প্রবঞ্চনাটা এড়াবার জন্যে। অনুমান, আগম ইত্যাদি জ্ঞানের তথাকথিত অন্যান্য উৎসের দোহাই দিয়ে পরবঞ্চনপ্রবণ ধর্মছদ্মধূর্তের দলে সাধারণ মানুষের মনে স্বর্গাদি প্রাপ্তি সম্বন্ধে একটা মোহের সঞ্চার করে। এই সংকট থেকে বাঁচতে হলে সাধারণ লোকের পক্ষে প্রত্যক্ষ ছাড়া আর কোনো প্রমাণকে স্বীকার করা নিরাপদ নয়। মণিভদ্রের ভাষায় :
এবম্ অমী অপি ধর্মচ্ছদ্মধূর্তাঃ পরবঞ্চনপ্রবণা যৎ কিঞ্চিৎ অনুমানাগমাদিদার্ঢ্যম্ আদর্শ্য ব্যর্থম্ মুগ্ধজনান্ স্বর্গাদিপ্রাপ্তিলভ্যভোগাভোগপ্রলোভনয়া ভক্ষ্যতক্ষ্যগম্যাগম্যহেয়োপাদদেয়াদিসংকটে পাতয়ন্তি, মুগ্ধধার্মিকান্ধম্ চ উৎপাদয়ন্তি…(১০)
দ্বিতীয়ত,—এবং ওই দ্বিতীয় যুক্তিটা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ—লোকায়তিকেরা নাকি বলতেন, অপ্রত্যক্ষকে (অর্থাৎ কি না যা প্রত্যক্ষভাবে জানা যাচ্ছে না তাকেও) যদি সত্যের সম্ভাবনা দিতে হয় তাহলে দরিদ্রের পক্ষে তার দারিদ্র্যের কথা ভুলে যাওয়া অসম্ভব নয়, অসম্ভব নয় দাসের পক্ষে দাসত্বের কথা ভুলে যাওয়া। কেননা যে দরিদ্র তার পক্ষে দারিদ্র্যটুকুই প্রত্যক্ষ, যে দাস তার কাছে দাসত্বটুকুই প্রত্যক্ষ। কিন্তু যদি অপ্রত্যক্ষকেও অস্তিত্বের সম্ভাবনা দিতে হয় তাহলে দরিদ্রও ‘স্বর্ণরাশির মালিক হয়েছি’ এমন কথা কল্পনা করে নিজের দুস্থ অবস্থাকে অবহেলায় দলন করতে পারে, দাস মনে করতে পারে সে আর দাস নয়, স্বামী। এক কথায়, এইভাবে দরিদ্র-ধনিভাব ও সেব্য-সেবকভাব সব কিছু নস্যাৎ হয়ে যায়। মণিভদ্রের ভাষায় :
কিদ্ চ অপ্রত্যক্ষম্ অপি অস্তিত্বতয়া অত্যুপগম্যতে চেৎ জগৎ অনপহ্নুতম্ এব তাৎ, দরিদ্রঃ হি স্বর্ণরাশীঃ মে অভি ইতি অদ্ভুধ্যায় হেলয়া এব দৌঃস্থ্যম্ দলয়েৎ, দাসঃ অপি দ্বচেতসি স্বামিতাম্ অবলম্ব্য কিংকরতাম্ নিরাকূর্য্যাৎ ইতি।…এবং ন কশ্চিৎ সেব্য-সেবকভাবঃ দরিদ্রধনিতাবঃ বা স্যাৎ।(১১) (টাইপে কিঞ্চিত ভুল থাকতে পারে)
তার মানে কি এই এ লোকায়তিকেরা প্রত্যেক্ষের উপর এতোখানি জোরে যে দিতে চেয়েছিলেন তার কারণ তাঁরা মনে করেছিলেন এইভাবেই দরিদ্রকে তার দারিদ্র্য সম্বন্ধে সচেতন রাখা যাবে, দাসকে সচেতন রাখা যাবে দাসত্ব সম্বন্ধে? এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে, অজিত কেশকম্বলী, মক্ষলি গোসাল, পূর্ণ কস্যপ প্রমুখ যে-ক’জন দার্শনিককে সাধারণত বস্তুবাদী বা লোকায়তিক বলে স্বীকার করা হয় তাঁরা শুধু যে ক্রীতদাস ছিলেন তাই নয়, দাসত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও করেছিলেন! দাসত্ব-চেতনা মন থেকে মুছে গেলে এ-বিদ্রোহ নিশ্চয়ই সম্ভবপর নয়।
অবশ্যই মণিভদ্র কোথা থেকে লোকায়তিকদের এই যুক্তিগুলি সংগ্রহন করেছিলেন তা জানতে পারলে ওই প্রশ্নের জবাব ভালো করে বুঝতে পারা যেতো। কিন্তু তা জানবার কোনো উপায় নেই। কেননা, লোকায়তিকদের লেখা সমস্ত পুঁথিই বিলুপ্ত হয়েছে।
————————————
১০. মণিভদ্র : : ষড়্দর্শনসমুচ্চয়ের টীকা, ৮১ শ্লোক।
১১. Ibid.
০৩. বিলুপ্ত পুঁথির কথা
কোনো কালে লোকায়তিকদের লেখা পুঁথিপত্র বলতে সত্যিই কি কিছু ছিলো? ছিলো। তার প্রমাণ, ওই বৌদ্ধ পুঁথি বিদ্যবদান। তার প্রমাণ, পতঞ্জলির মহাভাষ্য। খোঁজ করলে হয়তো আরো প্রমাণ পাওয়া যাবে। কিন্তু এ-দুটি প্রমাণই বা কম কিসের?
দিব্যাবদানে(১২) স্পষ্ট ভাষায় লেখা আছে : লোকায়তং ভাষ্য-প্রবচনম্। লোকায়তের উপর এমন কি ভাষ্য ছিলো, প্রবচনও ছিলো। কতোদিন আগে ছিলো? কী নাম সেই ভাষ্যের? এই দুটি প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়। কোথা থেকে। পতঞ্জলির মহাভাষ্য থেকে। আধুনিক পণ্ডিতেরা অনুমান করেন, যিশুখ্রীষ্ট জন্মাবার অন্তত দেড় শ’ বছর আগে পতঞ্জলি তাঁর এই বিখ্যাত বইটি লিখেছিলেন। আর ওই বইতেই(১৩) ব্যাকরণের একটি নিয়ম ব্যাখ্যা করবার প্রসঙ্গে তিনি লোকায়তের উপর ভাগুরি নামের বর্ত্তিকা বা ভাষ্যের উল্লেখ করেছেন : বর্নিকা শব্দ স্ত্রী লিঙ্গে নাকি বর্ত্তিকাও বোঝাতে পারে, যেমন, ‘বর্নিকা ভাগুরি লোকায়তস্য, বর্ত্তিকা ভাগুরি লোকায়তস্য’। এর থেকে নিঃসন্দেহেই প্রমাণ হয় যে যীশুখ্রীষ্ট জন্মাবার অন্তত দেড় শ’ বছর আগে পর্যন্ত লোকায়ত-শাস্ত্র নিশ্চয়ই ছিলো, এবং তার উপর অন্তত একটি ভাষ্যও নিশ্চয়ই ছিলো, সে ভাষ্যের নাম ভাগুরি।(১৪)
কিন্তু এই নামটাই টিকে আছে। পুঁথিগুলি বিলুপ্ত হয়েছে।
কেন বিলুপ্ত হলো? সত্যি বলতে, তেমন জোর গলায় এ-প্রশ্নের কোনো জবাব দেবার উপায় নেই। তবে পণ্ডিত জবাহরলাল নেহেরু(১৫) বলছেন, খুব সম্ভব উত্তরযুগে পুরোহিতদল এবং সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীয়া ভারতবর্ষে বস্তুবাদীদের অনেক পুঁথিপত্র ইচ্ছে করে নষ্ট করেছিলো। যদি তাই হয় তাহলে নিশ্চয়ই মানতে হবে সেকালেও যে-মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে দেশশাসনের ক্ষমতা ছিলো তারাও জনগণের এই দর্শনটি সম্বন্ধে—অর্থাত লোকায়ত বা বস্তুবাদী দর্শন সম্বন্ধে,—খুব সহনশীলতার পরিচয় দেন নি। তার মানে, একালের সঙ্গে সেকালের যতো তফাতই থাক না কেন, অন্তত একটা বিষয়ে মিল আছে : জনসাধারণের ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে শাসক-সম্প্রদায়ের কঠিন বিধান।
অথচ ওই কথাটিই আবার পণ্ডিত জবাহরলাল নেহেরু মানতে রাজী নন, তাই তাঁর উক্তি স্ববিরোধী। প্রাচীন ভারতকে আবিষ্কার করতে এগিয়ে তিনি সেকালের যে-ছবিটি আমাদের সামনে তুলে ধরতে চান তার মূল কথা হলো,