———————————-
৬৮. Ibid 561; cf. G. Thomson AA 426 “…such a study must be undertaken by scholars, who, like Morgan, believe that ‘a mere property career is not the final destiny of mankind’.”
২০. অধিকার
প্রয়োজন ছাড়াও অধিকারীর কথা।
লোকায়ত-দর্শনের আলোচনায় কি অধিকার-ভেদের কথা সত্যিই তোলা উচিত? প্রশ্নটাকে সোজাসুজি এইভাবে পাড়লে নিশ্চয়ই জবাব দেবার অসুবিধে হবে। কিন্তু এই প্রসঙ্গেই একটি কথা উত্থাপন করবার অবকাশ পাওয়া যায়। কথাটা জরুরী।
লোকায়ত-দর্শনের আলোচয়ায় আমরা যতোই অগ্রসর হবো ততোই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর ভাবে দেখতে পাবো যে আলোচনার অনেক দলিলই সমাজ-বিকাশের এমন এক পর্যায়ের সঙ্গে জড়িত যে-পর্যায়ে পর্যায়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা রাষ্ট্রব্যবস্থার আবির্ভাব হয় নি। তাই ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা রাষ্ট্রব্যবস্থা অনাদি, সনাতন—এ-রকম কোনো ধারণা নিয়ে এগোলে দলিলগুলির তাৎপর্য চোখে পড়া কঠিন হবে। সাম্প্রতিক যুগে আমাদের দেশে এবং বিদেশেও দিকপাল ভারততত্ত্ববিদ তো বড়ো কম জন্মান নি। বরং, দলিলপত্র বলতে আমরা যেটুকু সংগ্রহ করেছি তার সবটুকুর সঙ্গেই তাঁদের পরিচিয় ছিলো। কিন্তু তবুও ব্যক্তিগত-সম্পত্তিকে তাঁরা সনাতন মনে করেছেন আর এই কুসংস্কাররের দরুনই তাঁদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ ও সংকীর্ণ হয়েছে। ফলে দলিলগুলি চোখের সামনে থাকলেও সেগুলির প্রকৃত তাৎপর্য দেখতে পাওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। কার্ল মার্কস্(৬৯) এক জায়গায় এই সীমাবদ্ধতার উল্লেখ করেই বলেছেন,
Owing to certain judicial blindness even the best intelligences absolutely fail to see the things which lie in front of their noses.
একরকমের আইনগত অন্ধতার দরুনই এমন কি সবচেয়ে উঁচুদরের বুদ্ধিমানেরাও একেবারে নাকের গোড়ায় যা রয়েছে তা মোটেই দেখতে পান না।
মার্কস্-এর কথায় পরে ফিরতে হবে। আপাতত শুধু এইটুকুই বলা দরকার যে মানব সমাজে যা কিনা নিছক আধুনিক যুগের অবদান সেইটুকুকে সনাতন বলে ভুল করলে প্রাচীন ভারতীয় পুঁথিপত্রের অনেক তাৎপর্যই চোখে পড়বে না। ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে যিনি চিরন্তন মনে করেন তিনি লোকায়ত দর্শনের তাৎপর্য কোনোদিনই বুঝতে পারবে কিনা সন্দেহ।
—————–
৬৯. K. Marx and F. Engels C 209.
১ম খণ্ড : পটভূমি । ২য় পরিচ্ছেদ : পদ্ধতি প্রসঙ্গে
লোকায়ত দর্শন – প্রথম খণ্ড : পটভূমি । দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : পদ্ধতি প্রসঙ্গে- দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
লোকায়ত দর্শনের আলোচনায় যে-পদ্ধতি অনুসরণ করেছি তার জন্যে আমি একান্তভাবেই অধ্যাপক জর্জ টম্সনের কাছে ঋণী। তাঁর নাম আমাদের পণ্ডিতমহলে মোটেই সুপরিচিত নয়, তাই শুরুতেই আমি তাঁর সামান্য পরিচয় দেবার চেষ্টা করবো।
০১. অধ্যাপক জর্জ টম্সন
অবশ্যই, তিনি ভারততত্ত্ববিদ নন, বর্তমানে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীক-এর অধ্যাপক। প্রাচীন গ্রীক বিষয়ে ব্যুৎপত্তির দিক থেকে আজকের ইয়োরোপে তাঁর সমকক্ষ পণ্ডিত সত্যিই মুষ্টিমেয়। এ-কথা যাঁরা অধ্যাপক টম্সনের সবচেয়ে বড়ো নিন্দুক তাঁরাও নিঃসংকোচে স্বীকার করেন। কিন্তু শুধু এইটুকু বললে তাঁর সম্বন্ধে কিছুই বলা হয় না।
কেননা, অধ্যাপক জীবনের প্রথমার্ধেই তিনি প্রাচীন গ্রীকতত্ত্বে অসামান্য ব্যুৎপত্তির পরিচয় দিয়েছিলেন। তখনই তিনি প্রাচীন গ্রীক পুঁথিপত্রের উপর য-সব টীকাভাষ্য রচনা করেছিলেন সেগুলি বিদগ্ধ সমাজে প্রামাণ্য বলে স্বীকৃত হয়েছিলো। অথচ, অমন প্রামাণ্য রচনার স্রষ্টা হয়েও উত্তর-জীবনে তিনি অনুভব করলেন, প্রাচীন পুঁথিপত্রগুলিকে সত্যিই ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না। ইয়োরোপে বহুদিন ধরে গ্রীক-বিষয়ে উচ্চাঙ্গের গবেষণা হওয়া সত্ত্বেও যে-যুগের পুঁথিপত্রগুলির প্রকৃত তাৎপর্য উদ্ধার করবার সবচেয়ে মৌলিক কাজটি তখনো বাকি থেকে গিয়েছে। এই চেতনা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে হতে শেষ পর্যন্ত তাঁর জীবনে এক গভীর সংকটের রূপ নেয়। দিনের পর দিন তিনি অম্বেষণ করে চলেন এমন কোনো পদ্ধতির যার সাহায্যে ওই সুদূর অতীতকে সম্যকভাবে চিনতে পারা সম্ভব হবে। শেষ পর্যন্ত সে-পদ্ধতি তিনি খুঁজে পেলেন। প্রাচীন গ্রীস তাঁর সামনে একেবারে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।
এ-বিস্ময় বড়ো কম নয়। তাঁর ওই আবিষ্কারের কাহিনী তাঁর মুখেই শুনেছিলাম।
সে-রাতটার কথা আমি কোনোদিন ভুলবো না। চোখ বন্ধ করলে পুরো দৃশ্যটি আজো স্পষ্ট দেখতে পারি।
রাত এতো গভীর হয়েছে যে কর্মমুখর বার্মিংহাম শহর নিস্তব্ধ, নিঝুম। আগুনের সামনে পা-দুটো এগিয়ে দিয়ে অধ্যাপক টম্সন কথা বলে চলেছেন। কথা বলতে বলতে একজন মানুষ কী তন্ময়ই না হয়ে যেতে পারেন! অথচ কল্পনা নয়, কবিত্ব নয়—বিজ্ঞানের ধারালো বিশ্লেষণ। যেন দুই আর দুই মিলে চার হচ্ছে, তারই হিসেব। এতো স্বচ্ছ, এতো তীক্ষ্ণ তাঁর প্রত্যেকটি কথা যে শুনতে শুনতে মনে হয়ে মাথার ভিতর একটার পর একটা কপাট খুলে যাচ্ছে। যে-সব কথার মানে থাকতে পারে বলে আগে কোনোদিনই ভাবতে পারি নি,—ভাববার মতো চিন্তার সঙ্গতি ছিল না,—সে-সব কথার সহজ তাৎপর্যটা তিনি যেন একেবারে চোখের সামনে তুলে ধরেন। বলেন, এই দিক থেকে ভেবে দেখো, দেখবে এতোটুকুও অস্পষ্ট নয়।