আর এই দিক থেকে ভারতীয় দর্শনের দলিলপত্রগুলিকে সত্যিই পরমাশ্চর্য মনে হয়। কেননা, সেগুলি থেকে আমরা স্পষ্টই দেখতে পাই, সমাজ ইতিহাসের আবর্তনের সঙ্গে দার্শনিক চেতনার আবর্তনটি কতো ঘনিষ্ঠ ভাবে সংযুক্ত : কেননা, প্রাক-বিভক্ত সমাজের ধ্যানধারণা যে প্রাক-অধ্যাত্মবাদীই এ-কথা ভারতীয় দার্শনিক পুঁথিপত্রের মধ্যে স্পষ্টভাবে পরিস্ফুট দেখতে পাওয়া যায়।
আগামীকালের নিঃশ্রেণীক সমাজের মধ্যে অতীতের সাম্যসম্পর্ককে অনেক উন্নত পর্যায়ে তুলে আনবার পরিচয়; আগামীকালের বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদও সেই রকমই প্রাক্-বিভক্ত সমাজের লোকায়তিক চেতনাকেই উচ্চতর পর্যায়ে ফিরিয়ে আনবে,—অবশ্যই মূক ও অচেতন দেহতত্ত্ব হিসেবে নয়, সচেতন ও সমৃদ্ধ বস্তুবাদী দর্শন হিসাবে!
জানি, সমাজ-ইতিহাসের সঙ্গে দর্শনের ইতিহাসকে ইতিভাবে মিলিয়ে বোঝবার চেষ্টার বিরুদ্ধে নানা রকম আপত্তি উঠবে। বিশেষত এই কারণে উঠবে যে শ্রেণীসমাজের কাঠামোর মধ্যেই বস্তুবাদী চিন্তাধারার বিকাশ ঐতিহাসিক ভাবে ঘটেছে। ভবিষ্যতে এই আপত্তি নিয়ে আলোচনা তোলবার অবকাশ পাবো। আপাতত, লোকায়ত-দর্শনের আলোচনায় এগিয়ে যে-অভিজ্ঞতাটিকে খুবই বিস্ময়কর মনে হয়েছে সেটুকুই বর্ণনা করা যাক।
ভাববাদী চিন্তার জন্মবৃত্তান্ত প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে এঙ্গেল্স্-এর যে-উক্তিটি উদ্ধৃত করেছি তার থেকেই একটা সমস্যার সূত্রপাত হয় : সমাজের সদরমহল থেকে শ্রমনিরত মানুষগুলির মর্যাদা ক্ষোয়া যাবার দরুনই যদি ভাববাদী ও অধ্যাত্মবাদী ধ্যানধারণার জন্ম হয় তাহলে প্রাগ-বিভক্ত সমাজের,—যৌথ শ্রমের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজের—মানুষদের মাথায় নিশ্চয়ই ভাববাদী বা অধ্যাত্মবাদী ধ্যানধারণা বিকশিত হবার কোনো অবকাশই ছিলো না। আর তা যদি না থাকে তাহলে সে-পর্যায়ের ধ্যানধারণাগুলি বস্তুবাদী হওয়াই সম্ভবপর,—এ-বস্তুবাদ যতো মূক ও অব্যক্তই হোক না কেন। কেননা, সাম্প্রতিক দার্শনিকদের হাজার রকম বাঙময় বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও মানতেই হবে, ভাববাদ বা অধ্যাত্মবাদের একমাত্র পাল্টা-চেতনা হলো বস্তুবাদ।
লোকায়তিক চেতনার উৎস সন্ধানে এগিয়ে দেখা গেলো, সত্যিই তাই। নানান দিক থেকে এ-বস্তুবাদের দারিদ্র অসহ্য ও এমন কি অভাবনীয়। তবুও এ-চেতনা প্রাক-অধ্যাত্মবাদী, কেননা, এর উৎসে প্রাগ-বিভক্ত যৌথ শ্রমের সমাজ!
————————
৬০. B. H. Kirman TMM 29.
৬১. I. P. Pavlov LCR Chapters 11, 20, 21 ইত্যাদি।
৬২. G. Thomson R 7.
৬৩. K. Marx and F. Engels GI 20 : “Division of labour only becomes truly such from the moment when a division of material and mental labour appears. (The first form of ideologists, priests, is concurrent.) From this moment onwards consciousness can really flatter itself that it is something other than consciousness of existing practice, that it really represents something without representing something real; from now on consciousness is in a position to emancipate itself from the world and to proceed to the formation of “pure” theory, theology, philosophy, ethics, etc. But even if this theory, theology, philosophy, ethics, etc.”
৬৪. F. Engels DN 288-9.
৬৫. শঙ্করমতে জ্ঞান বস্তুতন্ত্র, কর্ম পরুষতন্ত্র। ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ১.১.৮।
কালীবর বেদান্তবাগীশের তর্জমা ১:১০৫-৮ দ্রষ্টব্য।
৬৬. F. Engels SUS (Karl Marx, Selected Works 1:179)
৬৭. H. L. Morgan AS 562.
১৯. প্রয়োজন
এই পরিচ্ছেদ শেষ করবার আগে আর মাত্র দু’-একটা কথা তোলা দরকার।
আমাদের দেশে বহুদিন ধরেই প্রথা চলে আসছে, দার্শনিক আলোচনার শুরুতে চারটি কথা খুব খোলাখুলিভাবে বলে নেওয়া : অধিকার, বিষয়, সম্বন্ধ, প্রয়োজন। বিষয় ও সম্বন্ধের কথা কিছুটা বলা হয়েছে। প্রয়োজন ও অধিকারের কথাও তোলা দরকার।
লোকায়ত দর্শন নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনটা কী? প্রয়োজনের প্রসঙ্গ নিশ্চয়ই স্থান-কাল নিরপেক্ষ হতে পারে না। তাই, প্রশ্নটা হবে, আজকের দিনে আমাদের দেশে লোকায়ত দর্শনের চর্চার কী প্রয়োজন?
দেশের বাস্তব পরিস্থিতির কথা থেকেই শুরু করা দরকার।
সাধারণ মানুষ,—কাজ করে, আমাদের দেশে সে-শ্রেণীর মানুষের ধ্যানধারণারই নাম লোকায়তিক,—তারা নানা রকম সমস্যার ঘূর্ণিতে পড়ে শেষ পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক সমাধানের দিকে অগ্রসর হতে চেয়েছে। ফলে, অধ্যাত্মবাদী ও ভাববাদী ধ্যানধারণা বর্জন করে তারা চাইছে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের কাছ থেকেই পথনির্দেশ পেতে। কিন্তু সেই সঙ্গেই শোনা যায় আর একদল বলছেন, এ সবই শুধু বিদেশ থেকে আমদানি করা মতবাদ। আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সাম্যবাদেরও সম্পর্ক নেই, বস্তুবাদেরও নয়।
সাধারণ মানুষের পক্ষে তাই আজ ভেবে দেখা প্রয়োজন, এই আপত্তিগুলি সত্যি কিনা। প্রয়োজনটা শুধুমাত্র জ্ঞানের খাতিরে নয়। জীবনের তাগিদেও।
সাম্যসমাজের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন অতীত কোনো দেশের বা কোনো জাতিরই হতে পারে না। তার কারণ, আগেই বলা হয়েছে, পশুর রাজ্য পিছনে ফেলে এগিয়ে আসবার পথটা পৃথিবীর সব-দেশের সব-মানুষের পক্ষেই এক। আজকের দিনের যে-কোনো জাতি সভ্যতার যতো উঁচু শিখরেই পৌঁছুক না কেন, এককালে তাকে আদিম সাম্য-সমাজেই বাস করতে হয়েছে। এদিক থেকে অন্যান্য দেশের সংগে আমাদের দেশের তফাত প্রধানত দুটো। প্রথমত, আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে আজো নানান রকম মানুষ সেই পিছিয়ে-পড়া অবস্থায় টিকে আছে, এ-ঘটনা পৃথিবীর সমস্ত দেশে দেখা যায় না। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের উন্নত ও সংস্কৃত মানুষদের রচনাতেও এমন অনেক চিহ্ন থেকে গিয়েছে যেগুলিকে এই আদিম সাম্যসমাজের স্মারক ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।