তাই এ-কথা মনে করলে ভুল করা হবে যে সমাজে শ্রেণীবিভাগ দেখা দেবার আগে পর্যন্ত মানুষের মাথায় অধ্যাত্মবাদী বা ভাববাদী ধ্যানধারণার আবির্ভাব হবে কোনো অবকাশ ছিলো। শ্রম বা কর্ম বস্তুতন্ত্র। শঙ্করাচার্যের(৬৫) সমস্ত শক্তির যুক্তি সত্ত্বেও তাই। এ-কথা পরে প্রতিপন্ন করবার অবকাশ পাবো। আপাতত, যে-প্রশ্ন সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সেটা হলো আদিম সাম্যসমাজের—প্রাক-বিভক্ত সমাজের—মানুষদের ধ্যানধারণার কথা।
যে-সমাজে উৎপাদন-কর্মের সঙ্গে,—শ্রমের সঙ্গে,—সমস্ত মানুষেরই প্রত্যক্ষ যোগাযোগ সে-সমাজের চিন্তাচেতনাটা,—যতোই মুক ও অস্ফুট হোক না কেন,—প্রাক-অধ্যাত্মবাদী, অতএব লোকায়তিকই হওয়া স্বাভাবিক নয় কি? ভারতীয় দর্শনের দলিলপত্র তো তাই-ই প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু এখানে সমস্ত দলিল পেশ করবার অবকাশ নেই। তার বদলে সমস্যাটাকে আর একদিক থেকে দেখবার চেষ্টা করা যাক।
মানুষের উৎপাদন পদ্ধতিই তাকে আদিম প্রাক-বিভক্ত সমাজ থেকে শ্রেণীসমাজের আওতায় নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু উৎপাদন পদ্ধতির উন্নতি সেইখানেই শেষ হয় নি। এই উন্নতিই মানুষকে শ্রেণীসমাজের কাঠামোর মধ্যেই একের পর এক পর্যায় পার করে গিয়ে নিয়ে চলছে : দাস-সমাজ, সাম্নত-সমাজ, ধনতান্ত্রিক-সমাজ। ধনতান্ত্রিক-সমাজের পূর্ণ বিকাশই শ্রেণীবিভাগের শেষ সীমানা। কেননা, এই অবস্থায় পৌঁছে মানুষ দেখছে তার উৎপাদন শক্তি এমন অবিশাস্য হয়ে উঠেছে যে শ্রেণীসমাজের কাঠামোত মধ্যে একে আর কিছুতেই ধরে রাখা সম্ভব নয়। মানুষের উৎপাদন শক্তি যেন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে মানুষে-মানুষে বর্তমান সম্পর্কের বিরুদ্ধে, শ্রেণী-সম্পর্কের বিরুদ্ধে(৬৬)। আজকের দিনে ধনতান্ত্রিক সমাজে যে সংকট প্রকট হয়েছে তার সমাধান আগামীকালের শ্রেণীহীন সমাজ। এই শ্রেণীহীন সমাজের কথা আজ আর স্বপ্নকথা নয়, পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ আজ সচেতনভাবে সেইদিকে এগিয়ে চলেছে।
এই হলো মানব সমাজের তিনটি মূল স্তর : অতীতের প্রাক-বিভক্ত সমাজ, বর্তমানের শ্রেণীবিভক্ত সমাজ, আগামীকালের শ্রেণীহীন সমাজ।
অতীতের সেই প্রাক-বিভক্ত সমাজের সঙ্গে আগামীকালের শ্রেণীহীন সমাজের সম্পর্কটা কী রকম? আজকের মানুষ কি শ্রেণীসমাজের জ্বালায় যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে অতীতের প্রাক-বিভক্ত সমাজে ফিরে যেতে চাইবে নাকি?
—দাও ফিরে সে-অরণ্য, লও এ-নগর?
নিশ্চয়ই নয়।
আদিম সাম্যসমাজের আসল ভিত্তি ছিলো দারিদ্র্যের। সবাই সমান, কেননা, সবাই সমান গরিব। আর সবাই সমান গরিব, কেননা, উৎপাদনের পদ্ধতি তখন এমনই করুণ যে সবাই মিলে প্রাণপাত পরিশ্রম করে কোনোমতে সবাইকে টায়ে-টুয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
আগামীকালের সাম্যসমাজের ভিত্তিতে প্রাচুর্য। কেননা, গত কয়েক হাজার বছরের অক্লান্ত চেষ্টায় মানুষ তার উৎপাদন শক্তিকে এমন অবিশ্বাস্য ভাবে বাড়িয়ে ফেলেছে যে তারই সাহায্যে আজ অভাবনীয় ধনসম্পদ সৃষ্টি করা সম্ভব। তা সত্ত্বেও আজকের দিনে মানুষের দুঃখদৈন্য ঘুচছে না। তার কারণ ওই ধনসম্পদ আজ মানুষের অভাবমোচনে নিযুক্ত নয়। লাভ বিক্রি করবার জন্যেওই এগুলি তৈরি করা হয়। তার বদলে, মানুষের অভাব মোচনের উদ্দেশ্য নিয়ে বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা অনুসারে এই অবিশ্বাস্য উৎপাদন শক্তিকে কাজে লাগালে আজ যার-যা-দরকার তাই পাওয়া সম্ভব হবে। অভাব বলে কথাটিকে মানুষ ভুলে যাবে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে, পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা তোলবার সময় আমরা দেখবো, ঠিক এই প্রসঙ্গেই কার্ল মার্কস্ বলছেন, finding what is newest in what is oldest,—যা কিনা সবচেয়ে পুরোনো তারই মধ্যে যা সবচেয়ে নতুন তাকে দেখতে পাওয়া। সবচেয়ে নতুন মানে?—ব্যক্তিগত সম্পত্তির অভাব। শ্রেণীশোষণের অভাব। সবচেয়ে পুরানোর মধ্যেও—আদিম সাম্যসমাজেও—তাই-ই চোখে পড়ে।
কার্ল মার্কস্-ই প্রথম প্রমাণ করলেন, মানুষের ধ্যানধারণার চরম উৎদ হলো তার সমাজ-ব্যবস্থায়। তার তাই, সমাজ-বিকাশ সম্বন্ধে যে-কথা ধ্যানধারণার ইতিহাস সম্বন্ধেও তাই হওয়াই শুধু স্বাভাবিক নয়, অনিবার্যও।
তার মানে?
আগামীকালের সাম্যসমাজ অতীতের সাম্যসমাজটার দিকে ফিরে যাবার চেষ্টা নয়। কিন্তু তবুও অতীত যুগের সেই সমান-সহজ সম্পর্কটাকে ফিরে পাবার চেষ্টা নিশ্চয়ই : অভাবের ভিত্তিতে নয়, প্রাচুর্যের ভিত্তিতে; নিচুস্তরে নেমে গিয়ে নয়, অতীত যুগের সমান সম্পর্কটাকে উচ্চস্তরে তুলে এনে। মর্গান(৬৭) বলছেন :
It will be a revival, in a higher form, of the liberty, equality and fraternity of the ancient gentes.
অর্থাৎ, সেই প্রাচীন সমাজের গোষ্ঠীগুলিতে যে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা ছিলো আগামী কালের সমাজে, উচ্চতর পর্যায়ে, তার পুনরাবির্ভাব হবে।
দার্শনিক ধ্যানধারণার আলোচনায় ফিরে আসা যাক।
মানুষের কথা বাদ দিয়ে মানুষের ধ্যানধারণাকে বোঝবার অবকাশ যদি সত্যিই থাকতো তাহলে দর্শনের ইতিহাস প্রসঙ্গে সমাজ ইতিহাসের এই বহিঃরেখার অবতারণা অপ্রাসঙ্গিক হতো। কিন্তু অবান্তর নয়। ধ্যানধারণার কথা জানতে গেলে যাদের মাথায় ধ্যানধারণার আবির্ভাব হয়েছে তাদের কথাও জানা দরকার।
শ্রেণীবিভক্ত সমাজের গণ্ডি ছেড়ে আজকের মানুষ শ্রেণীহীন সমাজের দিকে এগিয়ে যাবার সময় সচেতনভাবে অধ্যাত্মবাদী ও ভাববাদী ধ্যানধারণাকে পরিত্যাগ করে বস্তুবাদী দর্শনে প্রতিষ্ঠা খুঁজছে। ওই শ্রেণীহীন সমাজের ভিত্তিতে কায়িক শ্রম ও মানসিক শ্রম,—কর্ম আর জ্ঞান,—দু’-এর ভিতরকার হারানো সম্পর্ক আবার ফিরে আসবে, আর সেই সঙ্গেই দূর হবে ভাববাদের বাস্তব ভিত্তি। মানুষ আর অধ্যাত্মবাদের আলেয়ায় ভুলে প্রবঞ্চনার জলাভূমিতে গিয়ে ডুবে মরবে না, ভাববাদের কথায় মোহগ্রস্ত হয়ে অবাস্তবের পায়ে মাথা কুটতে কুটতে বাস্তব সুখদুঃখগুলোকে ভুলে থাকবে না। তার বদলে, বাস্তব দুনিয়াকে একমাত্র সত্য বলে জেনে দিনের পর দিন একে এমন ভাবে বদল করে চলবে যাতে মানুষের সামনে খুলে যায় প্রকৃত কল্যাণের অসীম দিগন্ত।