তারপর এইভাবে এগোতে এগোতে মানুষ এসে পৌঁছলো একেবারে নতুন ধরনের এক অবস্থায়। শ্রমবিভাগের এমন এক নতুন পর্যায় দেখা দিলো যার সঙ্গে আগেরকার শ্রমবিভাগের গুণগত ও মৌলিক প্রভেদ। নতুন পরিস্থিতিটা কী রকম? একদিকে উৎপাদন-কর্মের সংগঠন আর একদিকে যারা বাস্তবিকই উৎপাদিন করবে তারা। যারা সংগঠক তারা নিজেরা উৎপাদনকাজে অংশগ্রহণ করবে না, নিজেরা পরিশ্রম করবে না, গতর খাটাবে না। তার বদলে তারা মাথা খাটাবে—সংগঠনের জন্যে শুধু মাথা খাটানোরই প্রয়োজন।
এই সংগঠকশ্রেণী থেকেই ক্রমশ দেখা দিলো পুরোহিত-শ্রেণী(৬২)। শুরুতেই তারা নিশ্চয়ই উৎপাদনের উপায়গুলির মালিক হয়ে বসে নি : তার বদলে তাদের দায়িত্ব ছিলো উৎপাদন কাজের তদারক করা এবং উৎপাদনের ওই উপায়গুলির রক্ষণাবেক্ষন করা—মাথা খাটিয়ে, ভেবেচিন্তে, পুতো সমাজের উৎপাদন কাজটির পরিচালনা করা। এ-দায়িত্ব তাদের স্বভাবতই অনেকখানি কর্তৃত্বের অধিকারী করেছিলো। কর্তৃত্বশক্তি না থাকলে পুরো সমাজটার কাজকর্ম পরিচালনা করা সম্ভবপর নয়।
এই কর্তৃত্বশক্তির প্রভাবেই কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত আর উৎপাদিন কাজের পরিচালক রইলো না, উৎপাদিনের উপায়গুলির শুধুমাত্র রক্ষক রইলো না। তারা ক্রমশই এগুলির মালিক হয়ে দাঁড়ালো। আর এইভাবেই আদিম প্রাক-বিভক্ত সাম্যসমাজ ভেঙে গিয়ে দেখা দিলো নতুন ধরনের সমাজ, শ্রেণীবিভক্ত সমাজ। একদিকে মালিক-শ্রেণী,—তারা মাথা ঘামাবে, কিন্তু গতর খাটাবে না। অপর দিকে শ্রমিক-শ্রেণী,—তারা শুধুই গতর খাটাবে, কিন্তু মাথা ঘামাবার সুযোগ-সুবিধে তাদের জন্যে নয়(৬৩)।
অর্থাৎ কিনা, সমাজে শ্রেণীবিভাগ দেখা দেবার দরুন শুধুই যে মালিকে-শ্রমিকে তফাত দেখা দিলো তাই নয়, তারই অনিবার্য অঙ্গ হিসাবে দেখা দিলো শ্রমের সঙ্গে চিন্তার বিচ্ছেদ, গতর খাটানোর সঙ্গে মাথা খাটানোর বিচ্ছেদ, কায়িক শ্রমের সঙ্গে মানসিক শ্রমের বিচ্ছেদ।
আর এই তথ্যটুকু মনে না রাখলে অধ্যাত্মবাদী ও ভাববাদী ধ্যানধারণার জন্মকাহিনী সত্যই বুঝতে পারা যাবে না। এঙ্গেলস্(৬৪) বলছেন :
With each generation, labour itself different, more perfect, more diversified. Agriculture was added to hunting and cattle-breeding, then spinning, weaving, metal-working, pottery, and navigation. Along with trade and industry, there appeared finally art and science. From tribes there developed nations and states. Law and politics arose, and with them the fantastic reflection of human things in the human mind: religion. In the face of all these creations, which appeared in the first place to be products of the mind, and which seemed to dominate human society, the more modest productions of the working hand retreated into the background, the more so since the mind that plans the labour process already at a very early stage of development of society (e.g. already in the simply family), was able to have the labour that had been planned carried out by other hands than its own. All merit for the swift advance of civilisation was ascribed to the mind, to the development and activity of the brain. Men became accustomed to explain their actions from their thoughts, instead of from their needs – (which in any case are reflected and come to consciousness in the mind) – and so there arose in the course of time that idealistic outlook on the world which, especially since the decline of the ancient world, has dominated men’s minds.
অর্থাৎ, বংশপরস্পরায় শ্রমের রূপান্তর হতে লাগলো; শ্রম আরো নিখুঁত আরো বিচিত্র হয়ে উঠতে লাগলো। শিকার ও পশুপাওনের সঙ্গে সংযুক্ত হল কৃষি; তারপর সুতোকাটা, কাপড় বোনা, ধাতুর কাজ। মৃৎশিল্প, নৌচালনা। বাণিজ্য ও শিল্পের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত আবির্ভাব হলো চারুকলা ও বিজ্ঞানের। গোষ্ঠী বদলে দেখা দিলো জাতি ও রাষ্ট্র। আইন এবং রাজনীতির আবির্ভাব হলো, আর সেই সঙ্গে মানব-মনে মানব-ব্যাপারেরই কাল্পনিক প্রতিবিম্ব : ধর্ম। এইসব সৃষ্টির পাশে,—যেগুলি কিনা মুখ্যত মনের সৃষ্টি বলেই প্রতীয়মান হয়েছিলো এবং মানবসমাজ নিয়ন্ত্রণে যেগুলির প্রভাবই সবচেয়ে বেশি মনে হয়েছিলো,—মানবহাতের অপেক্ষাকৃত সাদাসিধে কীর্তিগুলি পিছিয়ে পড়তে লাগলো, এবং ততোই বেশি পিছিয়ে পড়তে লাগলো যতোই কিনা যে-মন শ্রমের পরিকল্পনা করেছে সেই মনই নিজের হাত ছাড়াও অপরের হাতের সাহায্যে এই পরিকল্পিত শ্রমকে সফল করিয়ে নিতে শিখেছে—সমাজবিকাশের খুব পুরোনো পর্যায় থেকেই এ-ব্যবস্থার সূত্রপাত হয়েছে। সভ্যতার দ্রুত অগ্রগতির সমস্ত কৃতিত্ব গিয়ে পড়তে লাগলো মনের উপর, মগজের বিকাশ ও ক্রিয়ার উপর। প্রয়োজনের দিক থেকে চিন্তার ব্যাখ্যা করবার বদলে মানুষ ধ্যানধারণা দিয়েই চিন্তার ব্যাখ্যা করতে শিখলো (শেষ পর্যন্ত যদিও প্রয়োজনই ধ্যানধারণা হিসেবে মনের উপর প্রতিবিম্বিত হয়েছে ও চেতনায় ধরা দিয়েছে);—এইভাবেই কালক্রমে প্রকৃতি সম্বন্ধে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম হলো, এবং বিশেষ করে প্রাচীন যুগ শেষ হবার পর থেকে দৃষ্টিভঙ্গিই মানবমনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
ভাববাদ ও অধ্যাত্মবাদের জন্মকাহিনী আর কোথাও এর চেয়ে স্পষ্ট ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে কিনা খুবই সন্দেহের কথা। এবং, ভবিষ্যতে “বরুণ” নামের পরিচ্ছেদে আমরা দেখতে পাবো ভারতীয় দর্শনের দলিলপত্র কতো অভ্রান্তভাবে এই কথাগুলিই প্রমাণিত করে : আমাদের দেশে সমাজের সদরমহল থেকে কায়িক শ্রমের মর্যাদা যতোই মুছে গিয়েছে ততোই মানুষের চেতনায় জন্ম হয়েছে ভাববাদী ও অধ্যাত্মবাদী ধ্যানধারণার।