.১৮. সমাজ-বিকাশের ধারা
লোকায়তিক ধ্যানধারণার উৎস-সন্ধানে অগ্রসর হয়ে আমরা সমাজ-বিকাশের কোনো এক প্রাক্-সভা পর্যায়ে গিয়ে পড়েছি। কিন্তু সে-কথার তাৎপর্য ঠিক কী? তার মানে কি এই যে প্রাচীন সমাজের সেই মানুষেরা বুদ্ধিশুদ্ধির দিক থেকে এমনই খাটো বা নিকৃষ্ট ধরনের ছিলো যে অধ্যাত্মবাদী চিন্তাধারার মহিমাটা তারা বুঝতেই পারে নি? এক কথায় প্রশ্ন হলো,—এর কারণটা কি এই যে তাদের মগজের গড়নটাই বাজে রকমের ছিলো, তাই তারা ইহলোক ছাড়া আর কিছুই সত্যি বলে ভাবতে পারেনি? তাদের লোকায়তিক চেতনাটা কি শুধুই স্থূলবুদ্ধির পরিচায়ক?
তা নয়। আসল কারণটা মগজের গড়ন নয়, সমাজের গড়ন। সমাজের গড়নটা বদলেছে বলেই মানুষের মাথায় এক ধরনের ধ্যানধারণার বদলে আর এক ধ্যানধারণার উদয় হয়েছে।
আধুনিক বিজ্ঞান(৬০) অনুসারে গত হাজার তিন-চার বছরের মধ্যে মাপ বা গড়ন কোনো দিক থেকেই মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের খুব উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। তবুও তার চিন্তাচেতনায় আকাশ-পাতাল তফাত দেখা দিয়েছে। কী করে তা সম্ভব হলো? তার কারণ, যদিও মানুষের চিন্তাচেতনা তার স্নায়ুতন্ত্রের উপরই নির্ভরশীল, তবুও এই স্নায়ুতন্ত্রের উপরই পারিপার্শ্বিকের যে-অবিরাম ঘাত-প্রতিঘাত চলেছে তার কথা বাদ দিলে স্নায়ুতন্ত্রের স্বরূপটাই বুঝতে পারা সম্ভব নয়। এ-কথায় যাঁদের মনে সন্দেহ আছে তাঁরা পাভ্লভের(৬১) রচনাবলী থেকে প্রমাণগুলি দেখে নেবেন।
লোকায়তিক ধ্যানধারণাকে পিছনে ফেলে মানুষ যে এককালে অধ্যাত্মবাদী ও ভাববাদী ধ্যানধারণা্র আওতায় এসে পৌঁছেছিলো তার আসল কারণ তার স্নায়ুতন্ত্রে কোনো রকম আকস্মিক পরিবর্তন নয়,—আসলে তার সমাজ-সংগঠনের ক্ষেত্রে এ আমূল পরিবর্তন। অধ্যাত্মবাদের জন্মবৃত্তান্ত জানতে হলে এই পরিবর্তনটাকে ভালো করে বোঝা দরকার।
মানবসমাজের ইতিহাসটা একবার আগাগোড়া দেখবার চেষ্টা করা যাক।
আজ পর্যন্ত মানবসমাজের যে-ইতিহাস তাকে আমরা মোটের উপর তিনটি পর্যায়ে ভাগ করতে পারি :
এক : আদিম প্রাক-বিভক্ত সমাজ
দুই : বর্তমান শ্রেণী-সমাজ
তিন : আগামী কালের শ্রেণীহীন সমাজ
প্রাক-বিভক্ত সমাজটাকে বলা হয় আদিম সাম্যসমাজ। তার কারণ, এ-সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিচয় নেই, পরিচয় নেই রাষ্ট্রব্যবস্থার। শোষক নেই, শোষিত নেই, শাসক নেই, শাসিত নেই। সবাই স্বাধীন, সবাই সমান, মানুষে-মানুষে সত্যিই ভাই-ভাই ভাব। এ-রকম সমাজ যে কল্পনা নয়, বাস্তব—তার প্রমাণ? প্রমাণ হলো, আজো পৃথিবীর নানান জায়গায় এ-রকম সমাজ সত্যিই রয়েছে, তাই সে-সমাজ স্বচক্ষে দেখা যায়। লুইস্ হেনরি মর্গান এ-সমাজ সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান পাবার জন্যেই জীবনের বেশির ভাগ সময়টাই এ-হেন সমাজের মধ্যে কাটিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, এ-কয়জাও তিনি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করলেন যে পৃথিবীর যে-কোনো দেশের মানুষ আজ সভ্যতার যতো উচ্চ-স্তরেই পৌঁছোক না কেন, কোনো এক অস্পষ্ট অতীতে তারাও এই সমাজেই বাস করেছিলো।
এ-হেন প্রাচীন সমাজ সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য কেন? কেননা, এ-অবস্থায় মানুষের উৎপাদন-শক্তি এতো অনুন্নত যে সকলে মিলে প্রাণপণ পরিশ্রম করে দলের সকলের জন্যে কোনোমতে নিছক প্রাণ-ধারণের উপাদানগুলি প্রকৃতির কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারে। হাতিয়ার যদি উন্নত হয় তাহলে একজন মানুষের পক্ষে প্রচুর পরিমান জিনিস উৎপাদিন করা সম্ভব। কিন্তু হাতিয়ার যখন স্থূল ও প্রাকৃত তখন একজন মানুষ প্রাণপাত পরিশ্রম করে যেটুকু জিনিস উৎপাদন করতে পারে তাই দিয়ে কোনোমতে শুধু নিজেকে বাঁচানো সম্ভব। এ-অবস্থায় মানুষের শ্রম উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করতে শেখে নি, তাই এ-সমাজ উদ্বৃত্তজীবী বলে কোনো শ্রেণীর আবির্ভাবও সম্ভব নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সমানে-সমান সম্পর্ক। শুধু তাই নয়। এ-অবস্থায় কারুর পক্ষে একা একা বাঁচবার চেষ্টাও অসম্ভব : প্রকৃতিরাজ্যে বিঘ্ন বিপর্যয়ের অন্ত নেই, স্থূল হাতিয়ার হাতে দুর্বল মানুষদের একমাত্র ভরসা হলো সংখ্যা। মানুষের চেতনারও তাই ঝোঁকটা একের উপরে নয়, ব্যক্তির উপরে নয়, ব্যষ্টির উপরে নয়। তার বদলে, পুরো দলের উপর, সকলের উপর, সমষ্টির উপর। সমষ্টির চেষ্টাতেই মানুষের পক্ষে এ-অবস্থায় বাঁচা সম্ভবপর। তাই শ্রমে অংশ গ্রহণ করবার দিক থেকে সকলের সঙ্গে সকলের সমান, শ্রমের ফল ভোগ করবার দিক থেকেও সকলের সঙ্গে সকলে সমান।
কিন্তু মানুষের উৎপাদন-কৌশল চিরকার একই অবস্থায় টেকে থাকে নি। প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করতে করতেই মানুষের হাতিয়ার শানিত হয়েছে, উন্নত হয়েছে। এবং এইভাবে উন্নত হতে হতে একটা অবস্থায় পৌঁছে দেখা গেলো মানুষকে কোনোমতে টায়েটুয়ে বাঁচিয়ে রাখবার পক্ষে যতটুকু দরকার তার চেয়েও বেশি জিনিস মানুষ উৎপাদন করতে পারছে। এই অবস্থাতেই প্রথম দেখা দিলো শ্রম-বিভাগ : কিছু মানুষ শুধুমাত্র কারিগরি কাজ নিয়ে থাকবে, অন্ন-উৎপাদনের প্রত্যক্ষ দায়িত্বটা আর তাদের নিজেদের উপর থাকবে না, কেননা বাকি মানুষের উৎপন্ন অন্নের উদ্বৃত অংশটুকু থেকে তাদের খাবার যোগান দেওয়া হবে। এই শ্রমবিভাগের দরুনই মানুষের উৎপাদন-কৌশল দ্রুত উন্নত হতে লাগলো, কেননা, অন্ন উৎপাদনের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব থেকে যারা মুক্তি পেলো তারা উন্নততর উৎপাদন-যন্ত্র উৎপাদনে আত্মনিয়োগ করতে পারলো।