কিন্তু তার আগে, যে-প্রসঙ্গ থেকে এতো কথা উঠেছে সেটুকুর আলোচনা সেরে নেবার চেষ্টা করা যাক।
বৈদিক ঐতিহ্যের সঙ্গে লোকায়তিক ঐতিহ্যের তফাতটা উত্তর যুগে এতো প্রকট হওয়া সত্ত্বেও বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে বামাচারী ও এমনকি লোকায়তিক চেতনার এত অজস্র স্মারক কি করে টেকে রয়েছে?
তার কারণ নিশ্চয়ই লোকায়তিক ধ্যানধারণাও যে-রকম আকাশ থেকে জন্মায় নি, উত্তর যুগের বৈদিক অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদী ধ্যানধারণাও সেই রকমই আকাশ থেকে জন্মায় নি। উভয়ের উৎসই হলো সমাজ-বিকাশের নির্দিষ্ট পর্যায়ের মধ্যে। এখন, সমাজ-বিকাশের যে-সব বিভিন্ন পর্যায় সেগুলির মধ্যে বাঁধাধরা সম্পর্ক আছে : কোন পর্যায় আগের এবং কোন পর্যায় পরের, শুধু এইটুকুই সুনির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় নয়, এমন কি কোনো দেশের কোনো মানুষই আগের পর্যায়কে লঙ্ঘন করে একেবারে পরের পর্যায়ে উঠে যেতে পারে নি। তার মানে, পশুর রাজ্যে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলতে চলতে মানুষ যে শেষ পর্যন্ত সভ্যতার আওতায় এসে পৌঁছলো তা একটি নির্দিষ্ট পথ ধরে এগিয়েই, কয়েকটি নির্দিষ্ট ধাপ পেরিয়েই। এই দিক থেকে সব দেশের মানুষের অভিজ্ঞতাই মোটের উপর এক রকমের। তাই আজকের দিনেও পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়া মানুষেরা যে-অবস্থায় পড়ে রয়েছে সেই দিকে চেয়ে দেখলে এগিয়ে-যাওয়া মানুষের দল তাদের বিস্মৃত অতীতটাকে খুঁজে পাবে। কেননা, এগিয়ে-যাওয়া মানুষেরাও এককালে ঠিক ওই রকমেই পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ে ছিলো—সে-পর্যায় না পেরিয়ে একেবারে সরাসরি উন্নত পর্যায়ে উঠে আসা কোনো দেশের বা কোনো জাতের মানুষের পক্ষে সম্ভবপর হয় নি।
এ-কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করলেন লুইস্ হেনরি মর্গান। তার ‘প্রাচীন সমাজ’ নামের বই শুধুই যে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারে অমূল্য সম্পদ তাই নয়, যে-কোনো দেশের প্রাচীন পুঁথিপত্রের প্রকৃত তাৎপর্য-নির্ণয়ে অপরিহার্য হাতিয়ারও।
মানুষের ধ্যানধারণার সঙ্গে সমাজ-বিকাশের পর্যায়-বিশেষের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্কের কথা এবং এই পর্যায়-পরস্পরায় অনিবার্য ধারাবাহিকতার কথা মনে রাখলে বৈদিক সাহিত্যে বামাচারী ও লোকায়তিক ধ্যানধারণার স্মারকগুলি দেখে খুব বেশি বিস্ময়ের অবকাশ থাকবে না। কেননা, সমাজ-বিকাশের যে-পর্যায়ে লোকায়তিক ও বামাচারী ধ্যানধারণার উৎস, বৈদিক মানুষেরাও এককালে তার মধ্যে দিয়েই অগ্রসর হয়েছিলেন এবং সে-পর্যায়কে পিছনে ফেলে এলেও তাঁদের সাহিত্য থেকে তার স্মৃতি সম্পূর্ণভাবে মুছে যায় নি। এই স্মৃতি হিসেবেই সে-পর্যায়ের ধ্যানধারণার অনেক চিহ্ন বৈদিক সাহিত্যে টেকে গিয়েছে। তার মানে, বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকরা উত্তর যুগে যে-সব ধ্যানধারণাকে অমন ঘৃণার চোখে দেখতে শিখেছিলেন, এককালে তাঁদের নিজেদের মনেই—অর্থাৎ তাঁদেরই পূর্বপুরুষদের মনে—সেগুলি চরম সত্যের মর্যাদা পেতো।
——————–
৫৪. G. Thomson R 9
১৭. আর্য-অনার্য মতবাদের সংকট
আর ঠিক এই কথাটিকে স্পষ্টভাবে চেনবার পথে বিঘ্ন ঘটায় আধুনিক পণ্ডিত মহলে অত্যন্ত ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি মতবাদ। মতবাদটি হলো, আর্য-অনার্য বা আর্য-দ্রাবিড়-সংক্রান্ত মতবাদ : অনার্যদের এই দেশে প্রবেশ করবার পর শিক্ষিত ও সংস্কৃত আর্যদের চিন্তাধারার মধ্যে কিছু কিছু অসংস্কৃত অনার্য-বিশ্বাস প্রবেশ করেছিলো। কী করে করলো? তাই নিয়ে অবশ্য নানা মুনির নানা মত। ক্ষিতিমোহন সেন(৫৫) বলছেন, এ হলো করুণাময়ের লীলা। পণ্ডিত জবাহরলাল নেহেরু(৫৬) বলছেন, এর কারণ হলো আগন্তুক আর্যদের অসীম সহনশীলতা। এ. বি. কীথ(৫৭) অতো ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টাই করছেন না, শুধু ঘোষণা করছেন যে স্থানীয় অসভ্য মানুষদের নানান ধ্যানধারণা আর্যদের ধ্যানধারণার রাজ্যে ‘সেঁদিয়ে’ গিয়েছিলো।
এখন এই আর্য-অনার্য মতবাদ যে শেষ পর্যন্ত ধোপে কতোখানি টেকবে তা খুব সুনিশ্চিতভাবে বলা যায় না। এককালে বিদগ্ধ সমাজ এ-মতবাদ নিয়ে যতোখানি উৎসাহ দেখিয়েছিলো আজদের দিনে তার তুলনায় উৎসাহ অনেক কমেছে(৫৮)। এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় পণ্ডিতমহলের ঝোঁকটা দিক বদল করছে : এককালে ঝোঁক ছিলো যা কিছু উন্নত ধরনের চিন্তা তাকেই আর্য আখ্যা দেবার, একালে যেন তথাকথিত দ্রাবিড়দের প্রতিই শ্রদ্ধা ও পক্ষপাতটা বেশি(৫৯)।
অবশ্যই আমাদের পক্ষে এ-জাতীয় তর্কবিতর্কের মধ্যে প্রবেশ করবার সুযোগ হবে না, প্রয়োজনও নেই। আমাদের পক্ষে যেটুকু কথা প্রাসঙ্গিক সেটুকু হলো ভবিষ্যতে এই আর্য-অনার্য মতবাদের কপালে যাই থাকুক না কেন বর্তমানে এ-মতবাদ সত্য নির্ণয় প্রচেষ্টার যে বাধা সৃষ্টি করতে পারে সে-সম্বন্ধে সচেতন হওয়া। আসলে আর্যই বলুন, বৈদিক মানুষই বলুন, বা যাই বলুন না কেন—তাদের নিজেদেরও একটা অসভ্য অতীত ছিলো, এবং সে-অতীতের নানা স্মারক পরের যুগের বৈদিক সাহিত্যেও টেকে থাকতে বাধ্য; তাই সেগুলিকে নির্বিচারে অনার্য বা দ্রাবিড়দের কাছ থেকে গৃহীত মনে করা চলবে না। অর্থাৎ কিনা, এই আর্য-অনার্য মতবাদ সত্যই হোক আর ভ্রান্তই হোক—তারই মোহে আমরা যেন বৈদিক মানুষদেরই নিজস্ব অতীতটার সন্ধান প্রচেষ্টায় উদাসীন না হই।
—————
৫৫. ক্ষিতিমোহন সেন : ভারতের সংস্কৃতি, ভূমিকা।
৫৬. J. Nehoru DI 57, 60, 68, 78.
৫৭. A. B. Keith RPVU 18, 24, 33, 54, 91, 92 ইত্যাদি
৫৮. বাঙালীর ইতিহাস : নীহাররঞ্জন রায়। ভারতের সংস্কৃতি : ক্ষিতিমোহন সেন। S. Radhakrishnan HPEW, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
৫৯. Ibid.