সমস্যাটা মোটের উপর সমান বলে এমন তো হতেই পারে যে আমাদের দেশের পুরোনো পুঁথিপত্র নিয়ে আলোচনা খুবই জরুরী হবে। কেননা যদি কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে অন্য কোনো দেশের পুরোনো দলিল নিয়ে আলোচনা সার্থক হয়ে থাকে তাহলে সেই পদ্ধতির প্রয়োগ করেই প্রাচীন ভারতীয় চিন্তাধারার অনেক দুর্বোধ্য বিষয় আমরা হয়তো বুঝতে পারবো।
আর এইদিক থেকেই আমার সবচেয়ে বড়ো ঋণ অধ্যাপক জর্জ টম্সনের কাছে। যদিও তিনি ভারততত্ত্ববিদ্ নন, সংস্কৃতজ্ঞ নন,–গ্রীক ও লাতিন সাহিত্যে বিশেষজ্ঞ। বস্তুত আজকের পৃথিবীতে তাঁর মতো বড়ো গ্রীকতত্ত্ববিদ খুব কমই আছেন।
বৈদিক সাহিত্য নিয়ে আমরা যে-সব সমস্যার সম্মুখীন হই অধ্যাপক জর্জ টম্সন গ্রীক সাহিত্যে নিয়েও মোটের উপর তার অনুরূপ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন। এবং শেষ পর্যন্ত কোন পদ্ধতির সাহায্যে তিনি এ-সব সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছেন তার আলোচনা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদেই করেছি। কেননা, এই পদ্ধতির কথাটাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। এবং আমার স্থির বিশ্বাস, একালের ওই গ্রীকতত্ত্ববিদের অভিজ্ঞতা থেকে ভারততত্ত্ববিদরাও যদি লাভবান হতে রাজী হন তাহলে ভারততত্ত্বের আলোচনাতেও যুগান্তর আসবে। ব্যক্তিগত সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে সচেতন হয়েও আমি প্রাচীন পুঁথিপত্রের নানান রকম দুর্বোধ্য কথাবার্তার অর্থ নির্ণয়ে সাহসী হয়েছে তা প্রধাণত এই পদ্ধতির সাহসেই।
কিন্তু যে-কথা হচ্ছিলো : বৈদিক সাহিত্যে লোকায়তিক চেতনা এবং এমন কি বামাচারী ধ্যানধারণার স্মারক নিয়ে কথা। এ-ধরনের স্মারক যে অজস্র রয়েছে তার প্রমাণ হল বৈদিক সাহিত্যই, নমুনা দেখা যাবে পরের পরিচ্ছেদে। অথচ, উত্তরকালে আমাদের দেশে বৈদিক ও লোকায়তিক ঐতিহ্য এমনই বিরুদ্ধ হয়েছে যে খোদ বৈদিক সাহিত্যেই এ-জাতীয় স্মারক শর্ষের মধ্যে ভূতের মতো মনে হতে পারে। এমন ব্যাপার কী করে সম্ভবপর হলো?
————————-
৫১. A. Avalon PT preface x
১৫. মানুষ আর মানুষের ধ্যানধারণা
আপনি যদি মানুষের কথা বাদ দিয়ে মানুষের ধ্যানধারণাগুলিকে বোঝবার চেষ্টা করেন তাহলে এ-সমস্যার, এবং এই জাতীয় আরো অনেক সমস্যার, কোনোদিনই কোনো রকম কিনারা খুঁজে পাবেন না।
আপনি যদি মানুষের কথা মনে রেখে মানুষের ধ্যানধারণাগুলিকে বুঝতে রাজী হন তাহলে এ-সমস্যার, এবং এই রকম আরো অনেক সমস্যার, কিনারা খুঁজে পাবেন।
তাহলে শুরুতেই ঠিক করা দরকার, কোন পথে এগোবার চেষ্টা করবো।
আমাদের দেশে অনেকদিন ধরেই বলা হয়েছে, বেদ অপৌরুষেয়। অর্থাৎ কিনা, কোনো মানুষের রচনা নয়। এই কথা যে ঠিক নয় আশা করি তা খুব বড়ো করে আলোচনা করবার দরকার নেই। আধুনিক পণ্ডিতেরা নিশ্চয়ই একমত হয়ে বলবেন, এটা নেহাতই সেকেলে কুসংস্কার। কেননা খ্রীষ্টান পৃথিবীতেও আজকাল যে-রকম মেরী মাতার বিশুদ্ধ গর্ভধারণের বিস্ময়কর কাহিনীতে বিশ্বাস ক্ষয়ে গিয়েছে হিন্দু পৃথিবীতেও সেই রকম বেদের অপৌরুষত্বে বিশ্বাস শুলিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু ওই একই কুসংস্কার কী ভাবে অন্য মূর্তিতে আজকের দিনেও অনেক বিদ্বানের দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে রেখেছে তা ভালো করে দেখা দরকার।
কেউ কেউ মনে করেন, ধ্যানধারণার আলোচনায় শুধু মাত্র ধ্যানধারণার কথাটুকুই প্রাসঙ্গিক। তাই যাদের মাথায় এই ধ্যানধারণাগুলি এসেছিলো তারা কী খেতো, কী পরতো, কেমনভাবে বাঁচতো, অন্যান্য মানুষদের কোন চোখে দেখতে,–এই জাতীয় প্রশ্ন তোলা অবান্তর। যাঁরা আজো এ-কথা বলেন তাঁরা আসলে ওই পুরোনো কুসংস্কারেরই এক আধুনিক সংস্করণে আস্থাবান। কেননা ধ্যানধারণাগুলিকে এই চোখে দেখতে গেলে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতেই হবে ওগুলি যেন স্বয়ম্ভু, নিরালম্ব—আকাশে ফোটা ফুলের মতো। কিন্তু আকাশকুসুমটা ঠাট্টার কথা, বাস্তবের বর্ণনা নয়। কেননা আকাশে সত্যিই ফুল ফোটে না। তেমনি, আসমান থেকে ধ্যানধারণার জন্ম হয় না, শুধুমাত্র মানুষের মাথাটেই ধ্যানধারণার বিকাশ হয়। এবং সেগুলির উৎসে রয়েছে মানুষের পারিপার্শ্বিক। ধ্যানধারণার আলোচনা তাই যাদের ধ্যানধারণা তাদের কথা এবং মূর্ত পারিপার্শ্বিকের কথা বাদ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না।
ধ্যানধারণাগুলিকে খিলানের সঙ্গে তুলনা করা হয়। খিলান শূন্যে ভর করে থাকতে পারে না, তার জন্যে ভিত্তিস্তম্ভ প্রয়োজন। এই ভিত্তিস্তম্ভ হলো মানুষের মূর্ত সমাজজীবন। ধ্যানধারণাকে এইভাবে বোঝবার চেষ্টার নাম দেওয়া হয় ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা(৫৩)। আজকের দিনে অবশ্য নানা কারণে এবং নানাভাবে এই ব্যাখ্যাকে ভুল বলে প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করা হয়।
অথচ, এ-ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করাও যা বেদকে অপৌরুষেয় মনে করাও তাই। একই কুসংস্কার, শুধু রূপের তফাত—একটা সেকেলে, অপরটা একেলে। কিন্তু দু’-এরই মূল কথাটা হলো মানুষকে বাদ দিয়েও মানুষের ধ্যানধারণাকে বোঝা সম্ভবপর—ধ্যানধারণাগুলো সেন স্বয়ম্ভু, গগনকুসুমের মতো।
দ্বিতীয়ত, ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যাকে সত্য বলে মেনে অগ্রসর না হলে ভারতীয় দর্শনের নানা দুর্বোধ্য সমস্যার কোনো কিনারা করার চেষ্টাই অসম্ভব। কেন? তা বলবার অবকাশ পাবো পুরো বইটি জুড়েই। আপাতত, বৈদিক সাহিত্যে লোকায়ত ও বামাচারী চিন্তাধারার বিস্ময়কর স্মারকগুলির প্রসঙ্গে কথাটা যতোটুকু ওঠে শুধু সেইটুকুর উল্লেখ করা যায়।