সংহিতা, ব্রাহ্মণ, উপনিষদ নামের যে সাহিত্যরাশি তা রাতারাতি রচিত হয় নি, অনেক যুগ সময় লেগেছিলো,–ঠিক যে কতো শতাব্দী তার নিখুঁত হিসেব দেবার মতো ঐতিহাসিক গবেষণা এখনো বাকি আছে। কিন্তু সন-তারিখের হিসাব নিয়ে সুনিশ্চিত হতে না পারলেও অন্তত এটুকু কথা জোর গলায় বলবার মতো দলিল রয়েছে যে ওই কয়েক শতাব্দী ধরে বৈদিক মানুষেরা একই রকমের সমাজ-ব্যবস্থায় বাস করেন নি। তাঁদের সমাজজীবনে অনেক অদলবদল হয়েছে এবং সেই অদলবদলের পরিণাম হিসাবেই তাঁদের ধ্যানধারণাতেও অনেক রকম মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে, এইভাবে বদলাতে বদলাতে বৈদিক ঐতিহ্য শেষ পর্যন্ত উপনিষদের অধ্যাত্মবাদের রূপ পেলো, এবং তারো অনেক পরের যুগে শঙ্করাচার্য প্রমুখ দার্শনিকেরা নিজেদের চূড়ান্ত ভাববাদী দর্শনকে পেশ করবার সময় প্রচার করবার প্রাণপাত চেষ্টা করলেন যে তাঁদের ভাববাদটা নিষক ঔপনিষদিক বা বৈদান্তিক চিন্তাই। বেদের শেষে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল বলেই উপনিষদের আর একটি নাম বেদান্ত। এবং, শঙ্কর প্রমুখ দার্শনিকদের রচনা সাধারণভাবে দেশে এই ধারণাই সৃষ্টি করেছে যে বৈদিক সাহিত্যের আগাগোড়াই বুঝি ওই রকমের নিটোল অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদ।
সিদ্ধিদাতা কিন্তু এই ধারণাটিকে সন্দেহ করতে শেখান। কেননা গণপতিকে দেখতে পাবেন খোদ সংহিতাসাহিত্যের মধ্যেই। ঋগ্বেদ(৪৮)-এ পাবেন। যজুর্ব্বেদ(৪৯)-এ পাবেন। এবং, যেটা আরো বিস্ময়কর ব্যাপার, ঋগ্বেদ(৫০)-এ দেখবেন স্বয়ং বৃহস্পতির সঙ্গে গণপতির কোনো তফাত নেই। কথাটা জরুরী। কেননা, লোকায়ত দর্শনের আদিগুরু বলে যাঁর খ্যাতি তাঁর নামও বৃহস্পতিই।
আপত্তি উঠবে, নামে কী এসে যায়? ঋগ্বেদের ওই বৃহস্পতির সঙ্গে লোকায়ত-দর্শনের সত্যিই কোনো সম্পর্ক আছে কিনা তা খুবই সন্দেহের কথা। অন্তত কোনো রকম বাস্তব সম্পর্ক আজো ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হয় নি।
তা অবশ্য হয় নি। কিন্তু এতোদিন ধরে দেশে যে-ঐতিহ্যটা চলে আসছে তাকেও এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া তো যায় না!
তাছাড়া, কথা হলো বৈদিক ঐতিহ্যের সঙ্গে লোকায়তিক ধ্যানধারণার সম্পর্ক শুধুমাত্র ওই নামটিকে আশ্রয় করেই নেই। বস্তুবাদী চেতনার,–এমনকি ওই বামাচারী চেতনারও,–অজস্র স্মারক বৈদিক সাহিত্যে ছড়ানো রয়েছে। এতো অজস্র যে সেগুলিকে খুঁজে পাবার জন্যে খুব বড়োসড়ো বেদজ্ঞ পণ্ডিত হবারও প্রয়োজন নেই। এই বই-এর দ্বিতীয় পরিচ্ছেদেই এ-ধরনের কিছু কিছু চিহ্ন বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করেছি।
—————————
৪৮. ঋগ্বেদ ২.২৩.১।
৪৯. বাজসনেয়ী সংহিতা ২৩.১৯।
৫০. ঋগ্বেদ ২.২৩.১ cf. R. G. Bhandarkar VS 147ff.
১৪. ভাষাজ্ঞান ও হিন্দুশাস্ত্র
অথচ, আশ্চর্যের ব্যাপার বলতে হবে, দেশবিদেশের এতো বড়ো বড়ো সংস্কৃতজ্ঞরা বৈদিক সাহিত্যের সঙ্গে অমন নিবিড়ভাবে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও এই জাতীয় চিহ্নগুলিত তাৎপর্য নিয়ে বিশেষ কোনো আলোচনাই তোলেন নি। অনুমানে মনে হয়, তার আসল কারণ হলো তাঁরা একালের ধ্যানধারণাকেই একমাত্র সম্বল করে বৈদিক-সাহিত্য পাঠ করেছেন। ফলে, স্মারকগুলির—বিশেষ করে বামাচারের স্মারকগুলি,–কোনো রকম তাৎপর্য নির্ণয় করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় নি : অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা বৈদিক সাহিত্যের শুধু শব্দ-রাশিই গ্রহণ করেছেন। কেননা, বৈদিক সাহিত্য আর যাই হোক একালের ব্যাপার নয়। তাই শুধুমাত্র একালের ধ্যানধারণার সাহায্য নিলেই বৈদিক শব্দরাশি সম্বন্ধে হাজার স্পষ্ট জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও বৈদিক চিন্তাজগতের পুরো খবরটা পাওয়া সম্ভব হবে না। আর্থার এ্যাভেলন, ওরফে স্যর জন উড্রফ্(৫১), তন্ত্র-প্রসঙ্গেই বলেছিলেন, শুধুমাত্র ভাষাজ্ঞানের সাহায্যে হিন্দুশাস্ত্র বুঝতে পারা যাবে না, ভাষাজ্ঞান ছাড়াও আরো কিছুর দরকার আছে :
…more is required for the understanding of a Hindu Shastra than linguistic talent, however great.
বলাই বাহুল্য ভাষাজ্ঞানকে কোনো ভাবে ছোটো করবার চেষ্টায় তাঁর এই উক্তি উদ্ধৃত করছি না। বস্তুত, ভারতীয় পুঁথিপত্র বোঝবার ব্যাপার দেশ-বিদেশের দিকপাল বিদ্বানেরা গত কয়েক শতাব্দী ধরে যে অসামান্য পরিশ্রম এবং অতুলনীয় প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন তার উপর নির্ভর করতে না পারলে আজ আমরা অনেকাংশেই অন্ধ হয়ে থাকতাম। কিন্তু প্রাচীনেরাই বলেছেন, বেদবেদান্তের প্রকৃত তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করবার পথে শব্দার্থরাশি-গ্রহণ প্রথম সোপান হলেও সব নয়(৫২), তারপর আরো কিছুর দরকার পড়ে।
বৈদিক সাহিত্য বিচারে এ-কথা যে কতোখানি গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা প্রতিপদেই দেখতে পাবো। আর সেই সঙ্গে দেখতে পাবো, ঠিক কোন অর্থে কথাটা সত্যি। কেননা, প্রাচীনেরা যে-অর্থে কথাটা বলতেন তা ঠিক নয়।
এখানে অবশ্যই সব কথা আলোচনা করা যাবে না : বাক্যজন্য-জ্ঞান ছাড়াও প্রাচীন পুঁথিপত্রকে বোঝবার জন্যে আরো কী প্রয়োজন, শুধুমাত্র তার ইঙ্গিতটুকু দেওয়া যায়।
কিসের প্রয়োজন? একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির। তাই সমস্যা হলো, কোথা থেকে তা পাওয়া যাবে?
সমস্যাটা যদি কেবল আমাদের দেশের পুরানো পুঁথিপত্রের তাৎপর্য খোঁজবার সমস্যা হতো তাহলে না হয় অন্য কথা ছিলো। কিন্তু তা নয়। যে-কোনো দেশেরই পুরোনো কালের পুঁথিপত্র বোঝবার ব্যাপারে সমস্যা ওঠে, এবং মানবজাতির অভিজ্ঞতা যেহেতু সবদেশেই মোটের উপর এক ধরনের সেইহেতু সব দেশের বেলাতেই এ-সমস্যা মোটামুটি একই।