তাতার খাঁ–১২৬১-১২৬৬ খৃঃ
আর্সলন খাঁর পুত্র মহম্মদ তাতার খাঁ* সিংহাসনে অভিষিক্ত হইয়া সকলের অনুরাগ আকর্ষণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তিনি সম্রাট বুলবনকে বহুবিধ উপঢৌকন পাঠাইয়া তাঁহাকে বশীভূত করেন। এই উপঢৌকনের মধ্যে রেশমী কাপড় ও মস্লিন বহু পরিমানে ছিল, তাহা ছাড়া ৬৩টি হস্তী এবং বহু অর্থ রাজস্বস্বরূপ পাঠাইয়াছিলেন। বুলবন তাঁহার রাজত্বের সূচনায় এই সুপ্রচুর ভেট পাইয়া উহা একটা শুভচিহ্ন বলিয়া মনে করিয়াছিলেন এবং তাতারের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হইয়াছিলেন। তাতার খাঁ ১২৭৭ খৃঃ অব্দে প্রাণত্যাগ করেন।
তাতার খাঁর মৃত্যুর পর সম্রাট তদীয় বিশ্বস্ত ও প্রিয় অনুচর তোগ্রেলকে বঙ্গের অধিকার প্রদান করেন। তোগ্রেল সিংহাসনে অভিষিক্ত হইয়া উড়িষ্যা আক্রমণ করেন। তথা হইতে ফিরিয়াই নিজেকে স্বাধীন নৃপতি বলিয়া ঘোষণা করেন এবং ইহাও প্রচার করেন যে সম্রাট বেলিনের মৃত্যু ঘটিয়াছে। তখন দিল্লীশ্বর পীড়িত ছিলন। তাঁহার প্রিয়তম অনুচরের এই অকৃতজ্ঞতা ও দুর্ব্যবহারে একান্ত ব্যথিত হইয়া তিনি পীড়িত থাকা সত্ত্বেও তাঁহার মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদ না রটে এই জন্য নিজে রাজধানীতে প্রকাশ্যভাবে দেখা দিতে লাগিলেন এবং তোগ্রেলকে চিঠি লিখিলেন। তোগ্রেল মগীসুদ্দিন খেতাব গ্রহণ করিয়া স্বাধীন নৃপতি হইয়াছেন, তিনি সে চিঠি উপেক্ষা করিলেন। সম্রাট তাঁহার বিরুদ্ধে দুইবার দুইজন সেনাপতি পাঠাইলেন, কিন্তু তোগ্রেল (মগীসুদ্দিন) তাঁহাদিগকে পরাস্ত করিলেন। সম্রাট স্বয়ং বঙ্গদেশে আসিয়া লক্ষণাবতীর দিকে অভিযান করাতে কতকটা ভয় পাইয়া কতকটা লজ্জায় পড়িয়া, বঙ্গেশ্বর তাঁহার অর্থসম্পদ লইয়া যাজনগরে আশ্রয় লইলেন। সম্রাট চলিয়া গেলে পুনরায় গৌড়ে ফিরিবেন এই উদ্দেশ্য ছিল। সম্রাট গৌড়ে হিসামউদ্দিন নামক সেনাপতিকে বঙ্গের মসনদে বসাইয়া যাজনগরে মগীসুদ্দিন তোগ্রেলকে আক্রমণ করিতে অভিযান করিলেন। তোগ্রেল এমন চতুরতার সহিত পলায়ন করিতে লাগিলেন যে দিল্লীশ্বর কোথায়ও তাঁহার সন্ধান পাইলেন না। তিনি বহু চেষ্টার পর একদল বণিকের মুখে সংবাদ পাইয়া অতর্কিতভাবে তাঁহাকে আক্রমণ করিয়া নিহত করেন। দিল্লীশ্বরের এই অভিযানে স্বর্ণগ্রামের দনুজ রায় তাঁহাকে অনেক সাহায্য করিয়াছিলেন। সম্রাট স্বয়ং তোগ্রেলের হস্তী ও ধনসম্পদ আত্মসাৎ করিয়া গৌড়ে প্রত্যাবর্ত্তনপূর্ব্বক তাঁহার অন্তঃপুরের মহিলা ও শিশুদিগের শিরচ্ছেদের আদেশ করিলেন এবং তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা নাসিরুদ্দিনকে কখনও দিল্লীশ্বরের বিদ্রোহিতা না করেন (যিনিই দিল্লীর রাজতন্ত্রের মালিক হউন না কেন) এই শপথ গ্রহণ করাইয়া বঙ্গের মসনদে স্থাপিত করেন (১২৮০ খৃঃ)।
নাসিরুদ্দিন বগড়া খাঁ–১২৮২-১২৯১ খৃঃ
নাসিরুদ্দিনের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মহম্মদের অকস্মাৎ মৃত্যু হওয়াতে বৃদ্ধ সম্রাট অত্যন্ত বিচলিত হইয়া তাঁহাকে দিল্লীতে আসিতে লিখিলেন। তাঁহাকে নিজের কাছে ডাকাইয়া আনিয়া বলিলেন, “আমি বৃদ্ধ ও শোকবিচলিত হইয়াছি, যদিও মহম্মদের পুত্র খসরুই এই রাজ্যের প্রকৃত উত্তরাধিকারী, তথাপি সে অতি তরুণবয়স্ক, এত বড় রাজ্যের ভার সে বহন করিতে পারিবে না। আপাততঃ বঙ্গের শাসনের ভার অপর কাহারও উপর দিয়া তুমি কতকদিন এইখানেই থাক। আমি বেশীদিন বাঁচিব না। তুমি একটা ব্যবস্থা করিয়া রাজ্য রক্ষা করিল।
কিন্তু সম্রাট একটু একটু করিয়া ভাল হইতে লাগিলেন। নাসিরুদ্দিনের আর দিল্লীতে থাকিতে ভাল লাগিল না। রাজ্যের যাহা হয় হইবে, এই মনে স্থির করিয়া, মৃগয়ার ছল করিয়া বঙ্গদেশে ফিরিয়া আসিলেন।
পুত্রের এই ব্যবহারে সম্রাট অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইলেন, তিনি মহম্মদের পুত্র খসরুকে আনাইয়া তাঁহাকেই তাঁহার উত্তরাধিকারী পদে নির্দ্দিষ্ট করিয়া ৮০ বৎসর বয়ঃক্রমে পরলোকে গমন করিলেন (১২৮৬ খৃঃ)।
খসরু আইনতঃ উত্তরাধিকারী হইলেও, দিল্লীর আমিএরা তাঁহার দাবী উপেক্ষা করিয়া বঙ্গেশ্বর নাসিরুদ্দিনের অষ্টাদশবয়স্ক পুত্র কায়কোবাদকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করিলেন। এই বালক কুসঙ্গীদের হাতে পড়িয়া বিলাসস্রোতে গা ঢালিয়া দিলেন। নাজিমুদ্দিন নামক মন্ত্রীই সর্ব্বেসর্ব্বা হইয়া রাজ্য শাসন করিতে লাগিলেন। রাজা মন্ত্রীর কুপরামর্শে অতি নিষ্ঠুরভাবে খসরু ও কয়েকজন মন্ত্রীকে হত্যা করেন।
—————
* রাখালদাস বাবু তাতার খাঁর পরে শের খাঁ ও আমিন খাঁ এই দুই ব্যক্তির নাম এক যোগে ১২৬৬ খৃঃ হইতে ১২৭৮ খৃঃ নির্দ্দেশ করিয়া তাঁহাদের রাজত্বের কাল উল্লেখ করিয়াছেন।