তোগান খাঁ ও তমুর খাঁ; উভয়ের রাজত্ব–১২৪৪-১২৪৬ খৃঃ
তোগান খাঁর সঙ্গে গঙ্গাবংশীয় অনঙ্গ ভীমদেবের পুত্র নৃসিংহদেবের প্রথম যুদ্ধ একটি স্মরণীয় ঘটনা। নৃসিংহদেব তোগান খাঁর অনুপস্থিতিতে লক্ষণাবতী আক্রমণ করিয়া রাজভাণ্ডার লুণ্ঠন করিয়া চলিয়া যান। প্রতিশোধ লইবার জন্য তোগান খাঁ জাজনগর আক্রমণ করেন। কিন্তু প্রবলপরাক্রান্ত কলিঙ্গরাহ ও সামন্ত নামক তাঁহার সেনাপতির রণকৌশলে তোগান খাঁ পরাস্ত হইয়া ফিরিয়া আসেন। এই দুরবস্থায় বঙ্গেশ্বর দিল্লীতে সাহায্য প্রার্থণা করিয়া দূত প্রেরণ করেন। এখানে বলা উচিত প্রথমতঃ তোগান খাঁ উড়িশ্যার কটাসিন দুর্গ আক্রমণ করেন, প্রতিশোধের জন্য নৃসিংহদেব লক্ষণাবতী আক্রমণ করিয়াছিলেন। (১২৪৩-৪৪ খৃঃ।) দিল্লী হইতে তমুর খাঁ অনেক সৈন্য লইয়া বঙ্গে আগমন করেন। বঙ্গেশ্বর এই রাজকীয় সৈন্যের সাহায্যে কলিঙ্গরাজের বিরুদ্ধে অভিযান করিয়া এবারও ব্যর্থকাম হন। পরন্তু তোগান খাঁর উপর তমুর খাঁ জুলুম করিতে আরম্ভ করিয়া নিজেকে লক্ষণাবতীর অধীশ্বর বলিয়া ঘোষণা করেন। কোন একদিন প্রভাত হইতে দ্বিপ্রহর পর্য্যন্ত লক্ষণাবতীর বক্ষের উপর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলমান সৈন্যের বিবাদ নগরবাসীদের একটা উপভোগ্য বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। তোগান খাঁর লোকেরা তাঁহাকে পরিত্যাগ করে, এবং তমুর খাঁই ক্ষেত্র-নায়ক হন। শেষে একটা সন্ধি হইয়া এই স্থির হইল যে তমুর খাঁ রাজধানীর যত হস্তী, অশ্ব ও রাজভাণ্ডার তাহা লইয়া যাইবেন কিন্তু তোগান খাঁ বঙ্গের অধিপতি থাকিয়া যাইবেন। তাবকাৎ-ইনাসিরী লেখক মিনহাজ এই তোগান খাঁর সঙ্গে অনেক দিন ছিলেন এবং পূর্ব্বোক্ত সন্ধি অনেকটা তাঁহারই চেষ্টায় হইতে পারিয়াছিল। তমুর খাঁ প্রায় দুই বৎসর লক্ষণাবতী শাসন করিয়াছিলেন, সেই সময়ে তোগান খাঁ স্বীয় সৈন্যগণ দ্বারা পরিত্যক্ত হইয়া দূরে অবস্থিতি করিতেছিলেন। কেহ কেহ বলেন তোগান খাঁর রাজত্বকালে সুপ্রসিদ্ধ চেঙ্গিস খাঁ ৩০,০০০ সৈন্য লইয়া গৌড় আক্রমণ করিয়াছিলেন। গঙ্গাবংশীয় রাজগণ এই সময়ে প্রবল হইয়া মুসলমানদিগকে বারংবার পরাজিত করিয়াছিলেন, দ্বিতীয় নৃসিংহদেবের তাম্রশাসনে প্রথম নৃসিংহদেবের এই বিজয়ের কথা-উপলক্ষে লিখিত হইয়াছে–“তাহার অমিত বিক্রমে রাঢ় ও বরেন্দ্রীয় যবনাঙ্গনাগণের কজ্জলরাগমিশ্রিত অশ্রু-সুধা-ধবল-গঙ্গা-প্রবাহকে কালিন্দীর ন্যায় শ্যামায়মানা করিয়াছিল।”
মুলুক যুজবেক (মুগীস উদ্দিন)–১২৪৬-১২৫৮ খৃঃ
পরবর্ত্তী রাজা মুলুক যুজবেক সম্রাট আলতামাসের একজন তাতার দেশীয় দাস ছিলেন। ইনি দিল্লীর সম্রাটগণের প্রীতিলাভ করিয়া পরমুহূর্ত্তেই তাঁহাদের বিপক্ষতা করিয়াছিলেন। ইনু ষড়যন্ত্রী, অকৃতজ্ঞ ও স্বেচ্ছাচারী ছিলেন। তিনি সম্রাজ্ঞী রিজিয়া ও সম্রাট বাইরাম সাহ ইঁহাদের উভয়ের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। নানাভাগ্যবিপর্য্যয়ের পর বঙ্গের মসনদ পাইয়া ইনি সর্ব্বপ্রথমই প্রতিশোধ লইবার জন্য জাজপুরে অভিযান করেন। প্রথম ও দ্বিতীয় বারের যুদ্ধে কলিঙ্গরাজের পরাজয় হইল। কিন্তু তৃতীয় বার যুববেক ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্থ হইয়া পরাস্ত হইলেন। তাঁহার সমস্ত হস্তী শত্রুহস্তগত হইল। তন্মধ্যে তই মূল্যবান একটি শ্বের হস্তী ছিল। এই পরাজয়ের পর তিনি দিল্লী হইতে সৈন্য সাহায্য পাইয়া আর একবার গোপনে কলিঙ্গ্রাজের রাজধানী আক্রমণ করিয়া ভাণ্ডার লুণ্ঠন করিয়া লইয়া আসিলেন। বিজয়োল্লাসে যুববেক দিল্লীশ্বরের অধীনতাপাশ ছিন্ন করিয়া রক্ত, শ্বেত ও কৃষ্ণ–এই ত্রিবর্ণের চন্দ্রাতপ ব্যবহার এবং সম্রাট মুগীসউদ্দিন উপাধিধারণপূর্ব্বক নিজেকে স্বাধীন বলিয়া ঘোষণা করিলেন। তৎপরে তিনি অযোধ্যা-জয়ার্থ অভিযান করিতে কৃতসঙ্কল্প হন। কামরূপ-পতি পরাস্ত হইলে ইনি তাঁহার ধনরত্ন লুণ্ঠন করেন। তদবস্থায় কামরূপের রাজা মুগীশউদ্দিনের অধীনতা স্বীকারপূর্ব্বক তাঁহাকে বাৎসরিক প্রভূত রাজস্ব দিতে প্রতিশ্রুত হইয়া দূত প্রেরণ করেন, পরন্তু বঙ্গেশ্বরের নামাঙ্কিত মুদ্রা নিজরাজ্যে চালাইতেও স্বীকৃত হন। কিন্তু বিজয়দৃপ্ত মুগীশউদ্দিন এই সন্ধির প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিলেন। উপায়ান্তর না দেখিয়া হিন্দুরা পার্শ্ববর্ত্তী সমস্ত শষ্যক্ষেত্র ধ্বংস করিয়া ফেলিল এবং নদীর বাঁধ ভাঙ্গিয়া দিয়া তাহাদের দুর্গম দেশ জলমগ্ন করিয়া ফেলিল। এইবার মুগীশউদ্দিন শত্রুহস্তে পড়িয়া নিতান্ত লাঞ্ছিত হইলেন। হস্তিপৃষ্ঠে পলায়নপর বঙ্গেশ্বরকে সকলেই লক্ষ্য করিতে সুবিধা পাইল; একটি মারাত্মক বাণে বিদ্ধ হইয়া তিনি শয্যাশায়ী হইলেন। মুমূর্ষুকালে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে জীবিত বা নিহত পুত্রের মুখ দেখিতে চাহিলেন। কামরূপের রাজা এই প্রার্থনা মঞ্জুর করিয়া দিলেন। পুত্র বন্দী হইয়া সমীপবর্ত্তী হইল, অশ্রুসিক্ত চক্ষে তাঁহাকে দেখিতে দেখিতে তাঁহার প্রাণবায়ু বহির্গত হইল। (১২৫৮ খৃঃ।)
জালালুদ্দিন–১২৫৮, এক বৎসর; আর্সলন খাঁ–১২৫৮, ১২৬০-১২৬১ খৃঃ
১২৫৮ খৃষ্টাব্দে দিল্লীশ্বরের সনদ পাইয়া জালালুদ্দিন মসুদ লক্ষণাবতীর শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইলেন। কিন্তু তিনি মাত্র এক বৎসর ঐ পদে নিযুক্ত ছিলেন। কড়ার শাসনকর্ত্তা আর্সলন সহসা এক বিপুল বাহিনী লইয়া লক্ষণাবতী আক্রমণ করেন, জালালুদ্দিন নিহত হন (১২৫৮ খৃ;)। আর্সলন খাঁ দুই বৎসর মাত্র বঙ্গের গদি দখল করিয়াছিলেন। ১২৬০ খৃঃ অব্দে তাঁহার মৃত্যু হয়। রাখালদাসবাবু এই সময়ের মধ্যে ইজুদ্দিন বল্বন নামক আর একজন বঙ্গেশ্বরের নাম উল্লেখ করিয়াছেন।