আলিমর্দ্দন সুনতান আলাউদ্দিন–১২০৮-১২১১ খৃঃ
শিরানের মৃত্যুর পর আলিমর্দ্দন খিলজি দিল্লীশ্বরের সনদ লইয়া বঙ্গদেশের মসনদ দখন করেন (১২০৮-১২১১ খৃঃ)।
কুতুবুদ্দিনের মৃত্যুর পর আলিমর্দ্দন শ্বেতচ্ছত্রধারণপূর্বক নিজেকে স্বাধীন নৃপতি বলিয়া ঘোষণা করেন। এইবার তাঁহার কতকটা বুদ্ধিভ্রংশ হইয়াছিল, এ পর্য্যন্ত তিনি অক্লান্ত-কর্মা যোদ্ধা এবং রাজনীতিকুশল বুদ্ধিমান লোক বলিয়া পরিচিত ছিলেন। এখন সমস্ত ন্যায়সঙ্গত গণ্ডী অতিক্রম করিয়া তাঁহার গর্ব্ব আকাশস্পর্শী হইল। তিনি প্রকাশ্য দরবারে আপনাকে পারস্য, তুর্কিস্থান এবং দিল্লীর বাদশাহগণ হইতে শ্রেষ্ট বলিয়া প্রকার করিতে লাগিলেন এবং “তাঁহার অধিকার হইতে বহু দূরে অবস্থিত খোরাসান, ইরাক, গজনী, গোব ও ইস্ফাহানের অধিকার প্রত্যর্থিগণকে প্রদান করিতেন।” এই সকল রাজ্য তাঁহার অধিকার-বহির্ভূর,–শুনিলে চটিয়া যাইতেন। একদা পারস্য দেশের এক বণিক্ স্বীয় বহুমূল্য দ্রব্যাদি-বোঝাই জাহাজ জলমগ্ন হওয়াতে তাহার নিকট সাহায্যের প্রার্থী হন। আলাউদ্দিন তাঁহাকে ইসপাহানের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিয়া প্রধান মন্ত্রীকে এক ফরমান প্রস্তুত করিতে আদেশ দেন। এই উপহাস-যোগ্য নির্ব্বুদ্ধির ফল হইতে তাঁহাকে মন্ত্রী বুদ্ধি-কৌশলে রক্ষা করিয়াছিলেন। এই সকল বুদ্ধিহীনতা অবশ্য পার্শ্ববর্ত্তী রাজাদের বিরক্তিকর হইয়াছিল–তথাপি তাহা উপহাস-যোগ্য মনে করিয়া কেহ কোন প্রতিকূলতা করে নাই। কিন্তু তিনি কিছুদিন পরে অতিশয় নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার আরম্ভ করিয়াছিলেন; তাঁহার অত্যাচার শুধু আঢ্য ও সম্ভ্রান্ত হিন্দুদিদের উপর সীমাবদ্ধ রহিল না, তিনি অবিচারের খিলজিবংশীয় অনেক বড় লোককে হত্যা করিলেন। তাঁহাদের বংশধরগণের চক্রান্তে ১২১১ খৃষ্টাব্দে তিনি নিহত হন। আলিমর্দ্দনের হত্যার পর হসাম উদ্দিন ইউয়জ নামক ইবন বক্রিয়ারের পারস্যবাসী কোন প্রিয় সেনাপতি ‘গিয়াসউদ্দিন” উপাধি ধারণ করিয়া গৌড়ের মসনদ অধিকার করেন, ইহার পূর্ব্বে তিনি গঙ্গোত্রীর শাসন কর্ত্তা ছিলেন।
গিয়াসউদ্দিন ইউয়জ–১২১১-১২২৬ খৃঃ
কথিত আছে পারশ্য দেশের দুই দরবেশ ইঁহার ভাবী সৌভাগ্যসম্বদ্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করিয়া ইঁহাকে ভারতবর্ষে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। ইনি সিংহাসনে আরূঢ় হইয়া কামরূপ, ত্রিহুত ও পুরী জয় করেন। কিন্তু যদিও বীর্য্যবত্তায় ইনি ন্যূন ছিলেন না, ইঁহার রাজত্বের অধিক সময়ই লোকহিতকর কার্য্যে ব্যয়িত হইয়াছে। ইনি গৌড়ের অনেক রম্য অট্টালিকা নির্ম্মান করেন, তথায় অতি মনোজ্ঞ ও বিশাল এক মসজিদ, একটি বড় বিদ্যালয় ও অতিথিশালা প্রস্তুত করিয়া বীরভূম হইতে দেবকোট পর্যন্ত এক বিস্তৃত রাজপথ নির্ম্মান করেন। দশ বৎসর কাল ইনি শান্তির সহিত শাসন করিয়াছিলেন এবং ধনী ও দরিদ্র সর্ব্বশ্রেণীর প্রতি সমভ্যবে ন্যায়পরতা প্রদর্শন করিয়াছিলেন, কিন্তু শেষ ইনি আর দিল্লীতে রাজস্ব পাঠাইতেন না, দিল্লীশ্বর আলতামাস ক্রুদ্ধ হইয়া বঙ্গে অভিযান করেন। নির্ব্বিবাদে বিহার অধিকার করিয়া তিনি বঙ্গের দিকে আসিতেছিলেন, সে সময়ে গিয়াসউদ্দিন গঙ্গার সমস্ত জলযান দখন করিয়া সম্রাটের আসিবার পথ বন্ধ করিয়া ফেলেন। যাহা হউক একটি সন্ধি হইয়া এই কলহের মিটমাট হইয়া গেল। বঙ্গাধিপ দিল্লীশ্বরকে ৩৮টি হাতী এবং বহুলক্ষ টাকা দিয়া তাঁহার অধীনত্ব স্বীকার করেন। আলতামাস মুলক্ আলাউদ্দিনকে বিহারের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিয়া দিল্লীতে প্রত্যাবর্ত্তন করেন। কিন্তু সম্রাট্ যাইতে না যাইতেই গিয়াসউদ্দিন সন্ধির সর্ত্ত ভঙ্গ করিয়া বিহার করিয়া করিয়া প্রকাশ্যে বিদ্রোহী হন। আলতামাসের পুত্র যুবরাজ নাসিরুদ্দিন অযোধ্যা হইতে এক বিপুল বাহিনী সংগ্রহ করিয়া তদ্বিরুদ্ধে যাত্রা করেন। এই যুদ্ধে গিয়াসউদ্দিন নিহত হন। গিয়াসউদ্দিন অতি উদারচরিত্র এবং ন্যায়পরায়ন রাজা ছিলেন। এমন কি আলতামাস পর্য্যন্ত বলিতেন, “ইনি প্রকৃতই সুলতান হইবার যোগ্য।” ১২ বৎসর ব্যাপী রাজত্বের পর ১২২৬ খৃষ্টাব্দে ইঁহার মৃত্যু হয়।
নাসিরুদ্দিন মহমুদ–১২২৬-১২২৮ খৃঃ
হাসামুদ্দিন খিলিজি–১২২৮ খৃঃ, কয়েক মাস
ইখ্তিয়ার উদ্দিন–১২২৮-২৯ খৃঃ
আলাউদ্দিন জানি–১২৩০-১২৩১ খৃঃ
সেক উদ্দিন–১২২৩-১২৩৩ খৃঃ
যুবরাজ নাসিরুদ্দিন বঙ্গের রাজা হইয়া শ্বেতচ্ছত্র ও রাজদণ্ড-ব্যবহারের অনুমতি প্রাপ্ত হন। তিনি অতি দক্ষতার সহিত রাজদণ্ড চালনা করিয়াছিলেন। ১২২৮ খৃষ্টাব্দে ইঁহার মৃত্যু হয়, তখন খিলিজি সামন্তেরা বিদ্রোহী হইয়া বঙ্গদেশে অরাজকতা আনয়ন করে। আলতামাস পুনরায় স্বয়ং বাঙ্গলাদেশে আসিয়া সেই বিদ্রোহ নিবারণ করেন। বিদ্রোহীর নেতা হাসামুদ্দিন খিলিজি অতি অল্প সময়ের জন্য বঙ্গের মসনদ অধিকার করিয়াছিলেন। এই বৎসরের জন্য ইখ্তিয়ার উদ্দিন বঙ্গেশ্বর হইয়াছিলেন।
আলতামাস মুলক্ আলাউদ্দিনকে বঙ্গের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন, ইনি চার বৎসর রাজত্বের পর পরলোকগত হন। তৎপরে সেক উদ্দিন তুরুক রাজা হইয়া তিন বৎসর রাজ্যাশাসনপূর্ব্বক বিষ খাইয়া প্রাণত্যাগ করেন (১২৩৩ খৃঃ)।
তোগান খাঁ–১২৩৩-১২৪৪ খৃঃ
ইহার পরের বঙ্গাধিপ তোগান খাঁ তাতারদেশীয় লোক ছিলেন, ইঁহাকে তরুণবয়স্ক, সুশ্রী ও নানাগুণে ভূষিত দেখিয়ে আলতামাস ইঁহার পক্ষপাতী হইয়াছিলেন। ইনি প্রথমতঃ রোহিলখণ্ডে, পরে বিহার এবং সর্ব্বশেষে বাঙ্গলার শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইয়াছিলেন। যখন আলতামাস বাদসাহের কন্যা রিজিয়া দিল্লীর মসনদ প্রাপ্ত অন, তখন তোগান খাঁ তাঁহার নিকটা অনেক উপঢৌকনসহ একজন বাগ্মী দূত প্রেরণ করেন। রিজিয়া বঙ্গেশ্বরের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ দেখাইয়া তাঁহাকে ওমরাহগণের মধ্যে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ পদ দান করেন এবং বঙ্গের মসনদে স্থায়িরূপে ইঁহার আসন স্বীকার করেন। রাজত্বের প্রথম দিকে ইনি ত্রিহুত বিজয় করেন, তৎপরে দিল্লীশ্বর মামুদের শাসন বিশৃঙ্খল ও শিথিল দেখিয়া কড়া-মানিকপুর বঙ্গের অধিকারভুক্ত করিলেন।