শুনিয়া হাসিলা বৃত্রাসুর দৈত্যেশ্বর
কহিলা, “প্রলাপ না কি কহ মন্ত্রিবর?
আসিবে সমরে ফিরে অমর আবার;
এ অযথা কথা মন্ত্রি রচিত কাহার?
দানবের ভয়ে স্বর্গ পৃথিবী ছাড়িয়া,
লুক্কায়িত আছে সবে পাতালে পশিয়া!
সাধ্য কি দেবের পুনঃ হয় স্বর্গমুখ,
যাক্ কত কাল আরো ঘুচুক সে দুখ।
দৈত্যের প্রহার অঙ্গে যে করে ধারণ,
ফিরিবে না যুদ্ধে আর কখন সে জন।
বৃত্রাসুর থাকিতে, সে সৈন্য দেবতার
স্বর্গের দিকেও কভু চাহিবে না আর।
বোধ হয় প্রতিহারী, রক্ষক যাহারা,
অন্য কিছু শূন্যপথে দেখেছে তাহারা–
হয় কোন উল্কা কিংবা নক্ষত্র-পতন,
নিদ্রাঘোরে শূন্যপরে করেছে দর্শন।”
কহিলা সুমিত্র, “দৈত্যপতি, অন্যরূপ
বলিলা প্রহরিগণ, কহিয়া স্বরূপ।
গগনমার্গেতে দেব-অঙ্গের আভাস
দেখিয়াছে স্থানে স্থানে জ্যোতির প্রকাশ।
রক্ষক-প্রধানে ডাকি জিজ্ঞাসা করিলে,
বিদিত হইবে সর্ব স্বকর্ণে শুনিলে।”
দৈত্যেশ-আদেশে আসে রক্ষক-প্রধান
দাঁড়াইল সভাস্থলে পর্বত-প্রমাণ।
কহিলা দানবপতি, “কহ, হে ঋক্ষভ,
কি দেখিলা গত নিশি কিবা অনুভব?”
কহিলা ঋক্ষভ দৈত্য, “শুন দৈত্যনাথ,
ত্রিযামা রজনী যবে হেরি অকস্মাৎ,
দিকে দিকে চারিধারে ঈষৎ প্রকাশ,
জ্যোতির্ময় দেহ যেন উজলে আকাশ!
নক্ষত্র উল্কার জ্যোতিঃ নহে সে আকার;
জানি ভাল দেব-অঙ্গ-জ্যোতি যে প্রকার।
ভ্রম না হইল কভু ক্ষণকাল তায়,
চিনিলাম দেব-অঙ্গ-জ্যোতি সে আভায়।
ফুটিতে লাগিল ক্রমে ক্রমে দশদিকে,
যতক্ষণ অন্ধকার অংশুতে না মিশে।
দেখিলাম কত হেন সংখ্যা নাহি তার,
উঠিছে আকাশ-প্রান্তে ঘেরি চারিধার;
বহু দূরে এখন (ও) সে জ্যোতির উদয়–
দেবতা তাহারা কিন্তু কহিনু নিশ্চয়!”
বৃত্রাসুর জিজ্ঞাসিলা ঘুচাতে সন্দেহ
“ইন্দ্রের কোদণ্ডনাদ শুনিলা কি কেহ?
ইন্দ্র যদি সঙ্গে থাকে অবশ্য সে ধ্বনি
শুনিতে পাইত স্বর্গে সকলে তখনি!”
কহিলা ঋক্ষভ, “অন্য দানব যতেক,
ইন্দ্রের কোদণ্ডধ্বনি না শুনিলা এক!”
তখন দানব-ইন্দ্র বৃত্রাসুর কয়–
“দেবতা আসিছে সত্য কিবা তাহে ভয়?
একবার অস্ত্রাঘাতে পাঠাই পাতাল,
এইবার একেবারে ঘুচাব জঞ্জাল।
ইন্দ্র সঙ্গে নাই, যুদ্ধে পশিছে দেবতা,
বাতুল হয়েছে তারা কি ঘোর মূর্খতা!
সঙ্কল্প করিনু অদ্য শুন দৈত্যকুল,
সঙ্কল্প করিনু হের স্পর্শিয়া ত্রিশূল–
সূর্যেরে রাখিব ক’রে রথের সারথি,
চন্দ্র সন্ধ্যামুখে নিত্য যোগাবে আরতি,
পবন ফিরিবে সদা সম্মার্জনী ধরি,
অমরার পথে পথে রজঃ স্নিগ্ধ করি।
বরুণ রজক-বেশে অসুরে সেবিবে,
দেবসেনাপতি স্কন্দ পতাকা ধরিবে,
নির্ভয়ে সকলে নিজ নিজ স্থানে যাও,
সুমিত্র, নৈমিষারণ্যে ভীষণে পাঠাও।”
কহিয়া এতেক বৃত্রাসুর দৈত্যপতি,
সভা ভাঙ্গি সুমেরুর দিকে কৈলা গতি।
এখানে ত্রিদিব জুড়ে ছুটিল সংবাদ,
স্বর্গপুরী পূর্ণ করি হয় সিংহনাদ।
বাজিল দুন্দুভিধ্বনি শিখরে শিখরে,
কোদণ্ড-টঙ্কারে যেন গগন শিহরে।
প্রাচীরে প্রাচীরে উড়ে দৈত্যের পতাকা,
শিবের ত্রিশূল-চিহ্ন শিবনাম আঁকা।
মহা কোলাহলে পূর্ণ হৈল সর্বস্থল,
সাজিল দানবসাজে দানব সকল।
বৃত্রাসুর-পুত্র বীর রুদ্রপীড় নাম,
সুধন্য দানব-কুলে, দেখিতে সুঠাম।
ভূষিত ললাটদেশ, বিশাল উরস,
বাল্যকাল হ’তে যার অসীম সাহস,
সজ্জিত মাণিকগুচ্ছ কিরীট-শীরষে,
দেবতা আসিছে যুদ্ধে শুনিয়া হরষে,
সুমিত্রের করে ধরি, কত সে উল্লাস,
উৎসাহ-হিল্লোলে ভাসি করিল প্রকাশ,
মহাযোদ্ধা বৃত্রপুত্র, পূর্বের সমরে,
লভিলা বিপুল যশঃ যুঝিয়া অমরে।
আবার আসিছে যুদ্ধে দেবতা সকল,
শুনিয়া উৎসাহে মত্ত হৈলা মহাবল।
চলিলা মন্ত্রীর সহ আপন আলয়ে,
আন্দোলিয়া নানা কথা যুদ্ধের বিষয়ে।
স্বর্গদ্বারে দ্বারে চলে দৈত্য মহারথী,
হর্যক্ষ বিপুলবক্ষে পূর্বে কৈলা গতি।
ঐরাবণী বল যার ঐরাবণ প্রায়,
পশ্চিমে চলিলা বেগে নদী যেন ধায়।
শঙ্খধ্বজ দৈত্য–যার শঙ্খের নিনাদে
অমর কম্পিত হয়–উত্তর আচ্ছাদে।
দক্ষিণেতে সিংহজটা–সিংহের প্রতাপ
চলিলা দুর্ধর্ষ দৈত্য ভয়ঙ্কর দাপ।
স্বর্গের প্রাচীর ক্রমে দৈত্য কোটি জন–
ভীষণ–নৈমিষারণ্যে করিলা গমন।