সঙ্গে প্রিয়তমা সখী অনুগত,
ভ্রমে অরণ্যেতে দুঃখেতে সতত,
না পেয়ে দেখিতে সুমেরু-কায়।।
কষ্টে করে বাস শচী নরলোকে,
ইন্দ্র, ইন্দ্রালয়, ইন্দ্রত্বের শোকে
অন্তরে দারুণ দুঃখহুতাশ।”
শুনি দৈত্যপতি কহিলা, “সুন্দরি,
পাবে শচীসহ শচী সহচরী,
অচিরে তোমার পূরিবে আশ।।”
ঐন্দ্রিলা শুনিয়া সহর্ষ হইলা,
অধরে মধুর হাসি প্রকাশিলা,
পতিকর সুখে ধরে অমনি।
হাসিতে হাসিতে কন্দর্প আবার,
ধনুকে ঈষৎ করিল টঙ্কার,
শিহরে দানব দৈত্যরমণী।।
পুনঃ ছয় রাগ রাগিণী ছত্রিশ,
গীত-বৃষ্টি করে ভুলে আশীবিষ,
নব নব রস বিভাস করি।
পুনঃ সে ইন্দ্রিয় অবশ সঙ্গীতে,
অসুর-অসুরী শুনিতে শুনিতে,
চমকে চমকে উঠে শিহরি।।
কভু বীর-রসে ধরিছে সুতার,
দানব উঠিছে করি মার মার,
আবার সমরে পশিছে যেন।
অমর নাশিতে ধরিছে ত্রিশূল,
আবার যেন সে অমরের কুল,
বিনাশে সংগ্রামে ভাবিছে হেন।।
কখন করুণা-সারিতে ভাসিয়া
চলেছে ঐন্দ্রিলা নয়ন মুছিয়া,
কখন অপত্য-স্নেহেতে ভোর।
যেন সে কোলেতে হেরিছে কুমার,
স্তনযুগে স্বতঃ বহে ক্ষীরধার,
এমনি ত্রিদিব-সঙ্গীত ঘোর।।
কভু হাস্যরস করে উদ্দীপন,
কোথায় বসন কোথায় ভূষণ,
ঐন্দ্রিলা উল্লাসে অধীর হয়।
ক্ষণে পড়ে ঢলি পতির উৎসঙ্গে
ক্ষণে পড়ে ঢলি ফুলদল-অঙ্গে,
উৎফুল্ল বদন লোচনদ্বয়।।
অমনি অপ্সরা হইয়া বিহ্বল,
চলে ধীরে ধীরে তনু ঢল-ঢল,
নেত্র করতল অলকা কাঁপে।
ঈষৎ হাসিতে অধর অধীর,
অঙ্গুলি-অগ্রেতে অঞ্চল অস্থির,
টানিয়া অধরে ঈষৎ চাপে।।
চারিদিকে ছুটে মধুর সুবাস,
চারিদিকে উঠে হরষ-উচ্ছ্বাস,
চারিদিকে চারু কুসুম হাসে।
খেলে রে দানবী দানবে মোহিয়া,
বিলাস-সরিৎ-তরঙ্গে ডুবিয়া,
প্রমোদ-প্লাবনে নন্দন ভাসে।।
০১.০৩ বৃত্র-সংহার : প্রথম খণ্ড – তৃতীয় সর্গ
উঠিছে দানবরাজ নিদ্রা পরিহরি
ইন্দ্রালয়ে, শশব্যস্তে নানাদ্রব্য ধরি,
দানব, গন্ধর্ব, যক্ষ ছুটিয়া বেড়ায়,
গৃহ পথ রথ অশ্ব সত্বর সাজায়;
সাজায় সুন্দর করি পুষ্পমাল্য দিয়া,
গবাক্ষ গৃহের দ্বার শোভা বিন্যাসিয়া;
উড়ায় প্রাসাদ-চূড়ে দানব-পতাকা–
শিবের ত্রিশূল-চিহ্ন শিবনাম আঁকা।
ঘন করে শঙ্খধ্বনি; ঘন ভেরীনাদ;
চারিদিকে স্তব্ধ শব্দ ঘন ঘোর হ্রাদ।
শিখরে শিখরে বাজে দুন্দুভি গভীর,
ঘন ঘন ধনুর্ঘোষে গগন অস্থির।
ইন্দ্রালয় বিলোড়িত দানবের দাপে;
জয়শব্দে চরাচর মেরুশীর্ষ কাঁপে।
বাসবের বাসগৃহ গগন যুড়িয়া,
হিমাদ্রিভূধর তুল্য আছে বিস্তারিয়া।
স্ফটিকের আভা তায় ফুটিয়া পড়িছে,
হিমানীর রাশি যেন আকাশে ভাসিছে।
দ্বারদেশে ঐরাবত হস্তী সুসজ্জিত,
সসজ্জিত পুষ্পরথ দ্বারে উপস্থিত।
ইন্দ্রপুরীশোভাকর সভার ভবন,
কুবের সাজায় আনি বিবিধ ভূষণ,
সারি সারি মণিস্তম্ভ সাজাইয়া তায়,
সাজাইছে পুষ্পদাম চন্দ্রাতপ-গায়।
হায় রে সে ইন্দ্রাসন বসিত যাহাতে
বাসব অমরপতি, রাখিছে তাহাতে
মন্দার-পুষ্পের গুচ্ছ করিয়া যতন,
দানব আসিয়া ঘ্রাণ করিবে গ্রহণ।
ইন্দ্রের মুকুট দণ্ড আনি দ্রুতগতি
রাখিছে আসন পার্শ্বে ভয়ে যক্ষপতি,
সভাতলে বাদ্যযন্ত্র প্রস্তুত করিয়া
তটস্থ কিন্নরগণ দেখিছে চাহিয়া।
আতঙ্কে প্রবেশ-দ্বারে;–বিদ্যাধরী যত–
উর্বশী মেনকা রম্ভা ঘৃতাচী বিনত–
বসন-ভূষণ পরি সকলে প্রস্তুত,
কেবল নর্তন বাকী বাদন-সংযুত।
সমবেত সভাতলে করি যোড়কর,
অপ্সরা, কিন্নর, যক্ষ, সিদ্ধ, বিদ্যাধর।
সমবেত দৈত্যবর্গ সুদীর্ঘ শরীর–
হেনকালে শঙ্খধ্বনি হইল গম্ভীর;
অমনি সুযন্ত্রে বাদ্য বাজিল মধুর;
অমনি অপ্সরা-পায়ে বাজিল নূপুর;
পূরিল সুধার ঘ্রাণে সভার ভবন;
বহিল অমরপ্রিয় সুরভি পবন।
প্রবেশিল সভাতলে অসুর দুর্জয়;
চারিদিকে স্তুতিপাঠ জয় শব্দ হয়।
ত্রিনেত্র, বিশালবক্ষ, অতি দীর্ঘকায়,
বিলম্বিত ভুজদ্বয়, দোদুল্য গ্রীবায়
পারিজাত-পুষ্পহার বিচিত্র শোভায়।
নিবিড় দেহের বর্ণ মেঘের আভাস;
পর্বতের চূড়া যেন সহসা প্রকাশ,
নিশান্তে গগনপথে ভানুর ছটায়!–
বৃত্রাসুর প্রকাশিল তেমনি সভায়।
ভ্রুকুটি করিয়া দর্পে ইন্দ্রাসন ’পরে
বসিল, কাঁপিল গৃহ দৈত্য-দেহভরে।
মন্ত্রীরে সম্ভাষি দৈত্য কহিলা তখন;–
“সুমিত্র হে! ভীষণেরে করহ প্রেরণ
অচিরে অবনীতলে, নৈমিষ-কাননে;
ভ্রমে শচী সে অরণ্যে সুররামা সনে;
আসুক স্বরগপুরে অমরী সকলে,
যে বিধানে পারে কহ আনিতে কৌশলে।
কৌশলে না সিদ্ধ হয় প্রকাশিবে বল;
ঐন্দ্রিলা অভিলাষ করিব সফল।
বড় লজ্জা দিয়া কাল ঐন্দ্রিলা আমারে–
শচী ভ্রমে স্বতন্তরা না সেবি তাহারে।
সুমিত্র, সত্বর কার্য কর সম্পাদন,
ভীষণে নৈমিষারণ্যে করহ প্রেরণ।”
দৈত্যেন্দ্র-বচনে মন্ত্রী কহিলা সুমিত্র;–
“মহিষী-বাঞ্ছিত যাহা কিবা সে বিচিত্র!
আজ্ঞা তব শিরোধার্য দনুজের নাথ,
নৈমিষ-অরণ্যে দৈত্য যাবে অচিরাৎ।
নিবেদন আছে কিছু দাসের কেবল,
আদেশ পাইলে পদে জানাই সকল।।”
দৈত্যেশ কহিলা–“মন্ত্রি, কহ কি কহিবে,
অবিদিত বৃত্রাসুরে কিছু না থাকিবে।।”
কহিল সুমিত্র, “তবে শুন দৈত্যনাথ,
অমর পশিছে স্বর্গে করিতে উৎপাত;
কহিলা প্রহরী যারা ছিলা গত নিশি,
দেখেছে দেবের জ্যোতিঃ প্রকাশিছে দিশি।
অতি শীঘ্র বোধহয় দেবতা সকল,
রণ-আশে প্রবেশ করিবে স্বর্গস্থল।
এ সময় ভীষণেরে প্রেরণ উচিত
হয় কি না দৈত্যপতি ভাবিবে বিহিত,
সামান্য বিপক্ষ নহে জান দৈত্যপতি,
কঠোর সে অমরের যুদ্ধের পদ্ধতি।
দিবারাত্রি ক্ষণকাল নহিবে বিশ্রাম,
দুর্দম বিক্রমে সবে করিবে সংগ্রাম,
যত যোদ্ধা দানবের হবে প্রয়োজন,
এ সময়ে উচিত কি ভীষণে প্রেরণ?”