কহিলা সে হুতাশন সর্ব-অঙ্গে শিখা
প্রজ্বলিত হৈল তেজে পাতাল দহিয়া,
অগ্নির বচনে মত্ত আদিত্য-সকলে
ছুটিল হুঙ্কার শব্দে পুরী রসাতল।
একেবারে শত দিকে শত প্রহরণে,
কোটি বিজলীর জ্যোতি খেলিতে লাগিল।
পাতালের অন্ধকার ঘুচায়ে নিমেষে
দেখাইল চারিদিকে জ্যোতির্ময় দেহ।
তখন প্রচেতা মর্ত্যে বরুণ বিখ্যাত
উঠিল গম্ভীরভাব, ধীর মূর্তি ধরি,
পাশ-অস্ত্র শূন্যপরে হেলাইয়া যেন,
উন্মত্ত জলধিজল প্রশান্ত করিল।
দেখিয়া প্রশান্তমূর্তি দেব প্রচেতার
নিস্তব্ধ অমরগণ, নিস্তব্ধ যেমন
স্নিগ্ধ বসুন্ধরা, যবে ঝটিকা নিবারে
ত্রিরাত্রি ত্রিদিবা ঘোর হুহুঙ্কার ছাড়ি।
কহিলা প্রচেতা ধীর গম্ভীর বচন;–
“তিষ্ঠ দেবগণ ক্ষণকাল শান্তভাবে
হেন প্রগল্ভতা কভু নহে ত’ উচিত,
এ ঔদ্ধত্য অল্পমতি প্রাণীরে সম্ভবে।
যুদ্ধে দৈত্য বিনাশিয়া স্বর্গ উদ্ধারিতে
অনিচ্ছা কাহার দৈত্যঘাতী দেবকূলে?
কে আছে নারকী হেন দেব-নামধারী
দ্বিরুক্তি করিবে হেন পবিত্র প্রস্তাবে?
তথাপি প্রতিজ্ঞা-বাক্য-উচ্চারণ আগে
উচিত ভাবিয়া দেখা ফলাফল তার;
সামান্যেরও উপদেশে শুভপ্রদ কভু,
জ্ঞানীর মন্ত্রণা কভু না হয় নিষ্ফল।
কি ফল প্রতিজ্ঞা করি বিফল যদ্যপি?
সর্বজন-হাস্যাস্পদ হয়ে কিবা ফল?
অসিদ্ধ-প্রতিজ্ঞ লোক অনর্থ প্রলাপি
নমস্য জগতে, কার্যে সুসিদ্ধ যে জন।
অনেক মহাত্মা বাক্য কহিলা অনেক,
কার্যসিদ্ধি নহে শুধু বাক্য-আড়ম্বরে,
কোদণ্ড-নির্ঘোষ কর্ণে প্রবেশের আগে,
শরলক্ষ্য ধরাশায়ী হয় শরাঘাতে।
দেব-তেজ, দেব-অস্ত্র, দেবের বিক্রম,
বার বার এত যার কর অহঙ্কার,
এতদিন কোথা ছিল অসুরের সনে
যুঝিলে যখন রণে করি প্রাণপণ?
কোথা ছিল সে সকল যবে দৈত্য শূল
নিক্ষেপিল সুরবৃন্দে এ পুরী পাতালে?
সমর্থ কি হয়েছিলা করিতে নিস্তেজ
দুর্জয় বৃত্রের হস্ত দেব-অস্ত্রাঘাতে?
অস্ত্র সেই, বীর্য সেই, সেই দেবগণ,
অক্ষুণ্ণ, অসুরও সেই সুপ্রসন্ন বিধি
এখনো রক্ষিছে তারে অনিবার্য তেজে,
কি বিশ্বাসে পুনঃ চাহ পশিতে সংগ্রামে?
ভাগ্য নাই! ভাগধেয় মূঢ়ের প্রলাপ?
সাহস যাহার সদা সেই ভাগ্যধর।
তবে কেন ইন্দ্রবাণ-তেজঃ দুর্নিবার
অক্ষত শরীরে দৈত্য ধরিল বক্ষেতে?
কেন ইন্দ্র সুরপতি সর্বরণজয়ী
দনুজমর্দন নিত্য শূলের প্রহারে
অচেতন রণস্থলে হইলা আপনি,
চেতন-বিরতি যার নহে ক্ষণকাল?
কেন বা সে ইন্দ্র আজি নিয়তির ধ্যানে,
সঙ্কল্প করিয়া দৃঢ় করিয়া মানসে,
সুমেরু-শিখরে একা কাটাইছে কাল,–
কেন সুরপতি বৃথা এ ধ্যানে নিরত?
দেবগণ, মম বাক্য অকর্তব্য রণ
যতদিন ইন্দ্র আসি না হয় সহায়;
অগ্রে কোন দেবতায় করুন উদ্দেশ,
পশ্চাৎ যুদ্ধ-কল্পনা হবে সমাপিত।”
বরুণের বাক্যে সূর্যদেব ত্বিষাম্পতি
উঠিলা প্রখরতেজা–কহিলা সবেগে–
“বক্তব্য আমার অগ্রে শুন সর্বজন,
ভাবিও সে বৈধাবৈধ বাঞ্ছনীয় শেষে।
ত্রিজগতে জীবশ্রেষ্ঠ নির্জর অমর,
অদিতি-নন্দনগণ চির আয়ুষ্মান্
অনশ্বর দেববীর্য, শরীর অক্ষয়,
সর্বকালে, সর্বলোকে প্রসিদ্ধ এ বাদ।
অসুর অচিরস্থায়ী অদৃষ্ট অস্থির,
চঞ্চল দানবচিত্ত রিপু-পরবশ;
মন্ত্রী মিত্র কেহ নহে চির-আজ্ঞাবহ;
জয়োৎসাহ প্রভুভক্তি অনিত্য সকলি
সর্বকালে সর্বলোকে জান তথ্য এই,
দুরন্ত দানব তবে কত কাল সবে
দুর্বার সমরক্ষেত্রে সুরবীর্যানল,
কত কাল রণে দৈত্য সে রণে তিষ্ঠিয়া?
মম ইচ্ছা সুরবৃন্দ, দুরন্ত আহবে,
দহে সে দানবকুল ভীম উগ্রতেজে,
যুগে যুগে কল্পে কল্পে নিত্য নিরন্তর
জ্বলুক গগনব্যাপী অনন্ত সমর
জ্বলুক দেবের তেজ অমরা ঘেরিয়া,
অহোরাত্র অবিশ্রান্ত প্রখর শিখায়;
দহুক দানবকুল দেবের বিক্রমে
পুত্রপরম্পরা ঘোর চিরশোকানলে।
চিরযুদ্ধে দৈত্যদল হইবে ব্যথিত,
না জানিবে কোন কালে বিশ্রামের সুখ,
নারিবে তিষ্ঠিতে স্বর্গে দেব-সন্নিধানে,
হইবে অমর-হস্তে পরাস্ত নিশ্চিত।
অদৃষ্ট এতই যদি সদয় দানবে,
কোন যুগে নাহি হয় যুদ্ধে পরাজিত,
ভুঞ্জুক অদৃষ্ট তবে তিক্ত আস্বাদনে
চিরযুদ্ধে সুরতেজে দানব দুর্মতি।
ধিক্! লজ্জা! অমরের এ বীর্য থাকিতে
নিষ্কণ্টকে স্বর্গভোগ করে বৃত্রাসুর!
সুখে নিদ্রা যায় নিত্য দেব উপেক্ষিয়া–
স্বর্গ-বিরহিত দেব চিন্তায় ব্যাকুল!
নাহিক বাসব হেথা সত্য বটে তাহা,
কিন্তু যদি পুরন্দর আরো বহুযুগ
প্রত্যাগত নাহি হন, তবে কি এখানে
এইভাবে রবে সবে চির-অন্ধকারে?
চল হে আদিত্যগণ প্রবেশি শূন্যেতে,
দৈত্যের কণ্টক হয়ে অমরা বেষ্টিয়া
দগ্ধ করি দৈত্যকুল, যুগ-যুগকাল,
যুদ্ধের অনন্তবহ্নি জ্বালায়ে অম্বরে।
স্বর্গের সমীপবর্তী পর্বত-সমূহে
শিখরে শিখরে জানি শস্ত্রধারিবেশে
সুশাণিত দেব-অস্ত্রে নিত্য বরিষণে
দনুজের চিত্তশান্তি ঘুচাই আহবে।”
কহিলা এতেক সূর্য, ঝটিকার বেগে
চারিদিক্ হতে দেব ছুটিতে লাগিল,
উত্থিত বালুকা যথা, যখন মরুতে
মত্ত প্রভঞ্জন রঙ্গে নৃত্য করি ফেরে।
কিংবা যথা যবে ঘোর প্রলয়ে ভীষণ,
সংহার-অনলে বিশ্ব হয়ে ভস্মাকার
উড়ে অন্তরীক্ষপথে দিগন্ত আচ্ছাদি,
তেমতি অমরবৃন্দ ঘেরিলা ভাস্করে।
সকলে সম্মত শীঘ্র উঠি ব্যোমপথে,
বেষ্টিয়া অমরাবতী অরাত্রি অদিবা,
চিরসমরের স্রোতে ঢালিয়া শরীর,
দেবনিন্দাকারী দুষ্ট অসুরে ব্যথিতে।
০১.০২ বৃত্র-সংহার : প্রথম খণ্ড – দ্বিতীয় সর্গ
হেথা ইন্দ্রালয়ে নন্দন-ভিতর
পতিসহ প্রীতিসুখে নিরন্তর,
দানব-রমণী করিছে ক্রীড়া।