- বইয়ের নামঃ বৃত্র-সংহার
- লেখকের নামঃহেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং
- বিভাগসমূহঃ কাব্যগ্রন্থ
০১.০১ বৃত্র-সংহার : প্রথম খণ্ড – প্রথম সর্গ
বসিয়া পাতালপুরে ক্ষুব্ধ দেবগণ,-
নিস্তব্ধ, বিমর্ষভাব, চিন্তিত, আকুল,
নিবিড় ধূমান্ধ ঘোর পুরী সে পাতাল,
নিবিড় মেঘডম্বরে যথা অমানিশি।
যোজন সহস্র কোটি পরিধি বিস্তার–
বিস্তৃত সে রসাতল, বিধূনিত সদা
চারিদিকে ভয়ঙ্কর শব্দ নিরন্তর
সিন্ধুর আঘাতে স্বতঃ নিয়ত উত্থিত।
বসিয়া আদিত্যগণ তমঃ আচ্ছাদিত
মলিন নির্বাণ যথা সূর্য ত্বিষাম্পতি,
রাহু যবে রবিরথ গ্রাসয়ে অম্বরে;
কিংবা সে রজনীনাথ হেমন্ত-নিশিতে
কুজ্ঝটিমণ্ডিত যথা হীন দীপ্তি ধরে,
পাণ্ডুবর্ণ, সমাকীর্ণ পাংশুবৎ তনু–
তেমতি অমরকান্তি ক্লান্ত অবয়বে।
ব্যাকুল বিমর্ষভাব ব্যথিত অন্তর
অদিতি-নন্দনগণ রসাতলপুরে,
স্বর্গের ভাবনা চিত্তে ভাবে সর্বক্ষণ–
কিরূপে করিবে ধ্বংস দুর্জয় অসুরে।
চারিদিকে সমুত্থিত অস্ফুট আরাব,
ক্রমে দেববৃন্দ-মুখে বহে গাঢ় শ্বাস,–
ঝটিকার পূর্বে, যেন বায়ুর উচ্ছ্বাস
বহে যুড়ি চারিদিক্ আলোড়ি সাগর।
সে অস্ফুট ধ্বনি ক্রমে পুরে রসাতল
ঢাকিয়া সিন্ধুর নাদ গভীর নিনাদে;
কহিলা গম্ভীর স্বরে–শূন্যপথে যেন
একত্র জীমূতবৃন্দ মন্দ্রিল শতেক–
মহাতেজে সুরবৃন্দে সম্ভাষি কহিলা–
“জাগ্রত কি দানবারি সুরবৃন্দ আজ?
জাগ্রত কি অস্বপন দৈত্যহারী দেব?
দেবের সমরক্লান্তি ঘুচিল কি এবে?
উঠিতে সমর্থ কি হে সকলে এখন?
হা ধিক্! হা ধিক্ দেব! অদিতি-প্রসূত!
সুরভোগ্য স্বর্গে এবে দনুজের বাস!
নির্বাসিত সুরগণ রসাতল-ভূমে,
দেব-নাসিকায় বহে সঘন নিশ্বাস,
আন্দোলি পাতালপুরী, তীব্র ঝড়বেগে।”
দেব-সেনাপতি স্কন্দ উঠিয়া তখন
অবসন্ন, তেজঃশূন্য, অশক্ত, অলস।
“দুর্বিনীত, দেবদ্বেষী দনুজ প্রবেশে
পবিত্র অমরধাম কলঙ্কিত আজ
অজয় অমর শূর স্বর্গ-অধিকারী
দেববৃন্দ স্বরভ্রষ্ট পড়িয়া পাতালে,
ভ্রান্ত কি হইলা সবে? কি ঘোর প্রমাদ।
চিরসিদ্ধ দেবনাম খ্যাত চরাচরে,
‘অসুর-মর্দন’ আখ্যা–কি হেতু হে তবে
অবসন্ন আজি সবে দৈত্যের প্রতাপে?
চিরযোদ্ধা,– চিরকাল যুঝি দৈত্য সহ
জগতে হইলা শ্রেষ্ঠ সর্বত্র পূজিত
আজি কিনা দৈত্যভয়ে ত্রাসিত সকলে
আছ এ পাতালপুরে অমরা বিস্মরি!
কি প্রতাপ দনুজের কি বিক্রম হেন,
শঙ্কিত সকলে যাহে স্ববীর্য পাসরি?
কোথা সে শূরত্ব আজি বিজয়ী দেবের
শতবার রণে যায় দনুজ দলিয়া।
ধিক্ দেব! ঘৃণাশূন্য অক্ষুব্ধ হৃদয়ে
এতদিন আছ এই অন্ধতম পুরে।
দেবত্ব, ঐশ্বর্য, সুধা, স্বর্গ তেয়াগিয়া,
দাসত্বের কলঙ্কেতে ললাট উজলি।
ধিক্ হে অমর নামে, দৈত্যভয়ে যদি
অমরা পশিতে ভয় এতই পরাণে,
অমরতা পরিণাম পরিশেষে যদি
দৈত্য-পদাঙ্কিত পৃষ্ঠ চির-নির্বাসন!
বল হে অমরবৃন্দ–বল প্রকাশিয়া
এইরূপে চিরদিন থাকিবে কি হেথা?
চির-অন্ধতম পুরী এ পাতাল-দেশে,
দনুজের পদচিহ্ন ললাটে আঁকিয়া?”
কহিলা পার্বতী-পুত্র দেব-সেনাপতি।
দেবগণ বিচলিত করিয়া শ্রবণ,
কাঁপিতে কাঁপিতে ক্রমে সক্রোধ-মূরতি,
নাসারন্ধ্রে বহে শ্বাস বিকট উচ্ছ্বাসে।
যথা দগ্ধগিরি-স্রাব উদ্গিরণ আগে,
অগ্নির ভূধরে ধূম সতত নির্গমে,
বন জলকম্প, ঘন কম্পিত মেদিনী;
পার্বতী-নন্দন বাক্যে সেইরূপ দেবে।
তুলিয়া সুপৃষ্ঠে তূণ, পাশ শক্তি ধরি,
উঠিয়া অমরবৃন্দ চাহি শূন্যপানে,
পুনঃ পুনঃ খরদৃষ্টি নিক্ষেপি তিমিরে,
ছাড়িতে লাগিল ঘন ঘন হুহুঙ্কার।
সর্বাগ্রে অনলমূর্তি–দেব বৈশ্বানর,
প্রদীপ্ত কৃপাণ করে উন্মত্ত স্বভাব
কহিতে লাগিল দ্রুত কর্কশ-বচনে,
স্ফুলিঙ্গ ছুটিল যেন ঘোর দাবাগ্নিতে।
কহিল, “হে সেনাপতি! এ মণ্ডলী মাঝে
কোন্ ভীরু আছে হেন ইচ্ছা নহে যার
অমর-নিবাস স্বর্গে উদ্ধারিতে পুনঃ?
পুনঃ প্রবেশিতে তায় স্ববেশ ধরিয়া?
দানবে যুঝিতে আর কি ভয় এখন?
ভীরুতার হেতু আর আছে কি হে কিছু?
অমরের তিরস্কার সম্ভব যতেক
ঘটেছে দেবের ভাগ্যে দৈব-বিড়ম্বন।
স্বর্গ-অধোদেশে মর্ত, অধোদেশে তার,
অতল গভীর সিন্ধু–তাহার অধোতে,
অন্ধতম পুরী এই বিষম পাতাল,
তাহে এবে দৈত্য-ভয়ে লুক্কায়িত সবে।
দুঃখে বাস–ধূমময় গাঢ়তর তমঃ
মুহুর্তে মুহুর্তে ঘন ঘন প্রকম্পন,
সিন্ধু-নাদ শিরোপরি সদা নিনাদিত
শরীর-কম্পন হিমস্তুপ চারিদিকে।
এ কষ্ঠ অনন্তকাল যুগ-যুগান্তরে
ভুঞ্জিতে হইবে দেবে থাকিলে এখানে,
যতদিন প্রলয়ে না সংহার-অনলে
অমর-আত্মার ধ্বংস হয় পুনর্বার।
অথবা কপটি হয়ে ছদ্মবেশ ধরি
দেবের ঘৃণিত ছল ধূর্ততা প্রকাশি,
ত্রিলোক-ভিতরে নিত্য হইবে ভ্রমিতে
মিথ্যুক-বঞ্চকবেশে নিত্য পরবাসী।
নিরন্তর মনে হয় কাপট্য প্রকাশ
হয় পাছে কারও কাছে চিত্ত জাগরিত,
বিষম দুঃসহ চিন্তা ঘৃণা লজ্জাকর
সতত কতই আরো হৃদয়ে যন্ত্রণা।
সে কাপট্য ধরি প্রাণে জীবন-যাপন
শরীর-বহন আর, দুর্গতির শেষ;
বরঞ্চ নিরয়-গর্ভে নিয়ত নিবাস
শ্রেয়স্কর শতগুণ জিনি সে শঠতা।
অথবা প্রকাশ্যভাবে হইবে ভ্রমিতে
চতুর্দশ লোক-নিন্দা সহি অবিরত,
শত্রু-তিরস্কার অঙ্গে অলঙ্কার করি,
কপালে দাসত্ব-চিহ্ন করিয়া লাঞ্ছিত!
যখন ভ্রুকুটি করি চাহিবে দানব,
কিংবা সে অঙ্গুলি তুলি ব্যঙ্গ উপহাসে
দেখাইবে এই দেব স্বর্গের নায়ক,
শত নরকের বহ্নি অন্তরে দহিবে!
অথবা বর্জিত হয়ে দেবত্ব আপন
থাকিতে হইবে স্বর্গে–মার আছে যথা
অসুর-উচ্ছিষ্ট গ্রাসি পুষ্ট-কলেবর,
অসুর-পদাঙ্ক-রজঃ ভূষণ মস্তকে।
তার চেয়ে শতবার পশিব গগনে
প্রকাশি অমর-বীর্য সমরের স্রোতে
ভাসিব অনন্তকাল দনুজ-সংগ্রামে,
দেবরক্ত যতদিন না হইবে শেষ।
অমর করিয়া সৃষ্টি করিল যে দেবে
পিতামহ পদ্মাসন–সুমনস্ খ্যাতি,
ব্রহ্মাণ্ড ভিতরে যারা সর্ব গরীয়ান্,
অদৃষ্টের বশে হায় তাদের এ গতি!
দেবজন্ম লাভ করি অদৃষ্টের বশ,
তবে সে দেবত্ব কোথা হে অ-মর্ত্যগণ?
দেব-অস্ত্রাঘাতে নবে দানব-বিনাশ,
সে দেববিক্রমে তবে কিবা ফলোদয়?
নিয়তি স্বতঃ কি কভু অনুকূল কারে,
দেব কি দানব কিংবা মানব-সন্তান?
সাহসে যে পারে তার কাটিতে শৃঙ্খল,
নিয়ত কিঙ্কর তার শুন দেবগণ!
ধর শক্তি, শক্তিধর, হও অগ্রসর,
জাঠা, শক্তি, ভিন্দিপাল, শেল, নাগপাশ,
সুরবৃন্দ সুরতেজে কর বরিষণ,
অদৃষ্ট খণ্ডন করি সংহার অসুরে।”