জীবানন্দ। কি হুকুম রায়মশায়?
জনার্দন। আমার পুকুরধারের জায়গায় বেড়া ভেঙ্গে মন্দিরের জমির সঙ্গে এক করিয়ে দিয়েছেন?
জীবানন্দ। কোন্ জায়গাটা বলছেন? যেখানে বছর-কুড়ি পূর্বে মন্দিরের গোশালা ছিল?
জনার্দন। আমি ত জানিনে কবে আবার—
জীবানন্দ। অনেকদিন হয়ে গেল কিনা! বোধ হয় নানা কাজের ঝঞ্ঝাটে কথাটা ভুলে গেছেন।
জনার্দন। (দুঃসহ ক্রোধ দমন করিয়া) কিন্তু এ-সব করার আগে হুজুর ত আমার কাছে একটা খবর পাঠাতে পারতেন।
জীবানন্দ। খবর পৌঁছোবেই জানি। দু’দণ্ড আগে আর পরে। কিছু মনে করবেন না।
জনার্দন। কিন্তু আগে জানলে মামলা-মকদ্দমা হয়ত বাধত না।
জীবানন্দ। এতেও বাধা দেওয়া উচিত নয় রায়মশায়। ভৈরবীদের হাতে দেবীর বহু সম্পত্তিই বেহাত হয়ে গেছে। এখন সেগুলো হাত-বদল হওয়া দরকার।
জনার্দন। (শুষ্ক হাস্য করিয়া) তার চেয়ে আর ভালো কথা কি আছে হুজুর। শুনতে পাই সমস্ত গ্রামখানাই একদিন মা-চণ্ডীর ছিল। এখন কিন্তু—
জীবানন্দ। জমিদারের গর্ভে গেছে? তা গেছে। তারও ত্রুটি হবে না রায়মশায়! মন্দিরের দলিল, নকশা, ম্যাপ প্রভৃতি যা-কিছু আছে কলকাতায় এটর্নির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমার একলার সাধ্য কি? আপনারা এ-কাজে আমার সহায় থাকবেন।
জনার্দন। থাকব বৈ কি হুজুর। আমরা চিরকাল হুজুর সরকারের চাকর বৈ ত নয়।
[জনার্দন প্রস্থান করিল। জীবানন্দ সকৌতুক হাসিমুখে তাহার প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া ক্ষণকাল নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন]
প্রফুল্ল। দাদা কি শেষে একটা লঙ্কাকাণ্ড বাধাবেন নাকি?
জীবানন্দ। যদি বাধে সে ভাগ্যের কথা প্রফুল্ল। তার জন্যে দেবতাদের একদিন তপস্যা করতে হয়েছিল।
প্রফুল্ল। দেবতারা পারেন। লঙ্কার বাইরে বসে তপস্যা করায় পুণ্যও আছে, দুশ্চিন্তাও কম। কিন্তু লঙ্কার ভিতরে যারা বাস করে, লঙ্কাকাণ্ডের ব্যাপারে তাদের ভাগ্যকে ঠিক সৌভাগ্য বলা চলে না। এসে পর্যন্ত গ্রামসুদ্ধ লোকের সঙ্গে বিবাদ করে বেড়ানো আপনার গৌরবেরও নয়, প্রয়োজনও নয়। ইতিমধ্যে নানাপ্রকার কার্যই ত করা গেল, এখন ক্ষান্ত দিয়ে চলুন বাড়ি ফিরে যাওয়া যাক।
জীবানন্দ। সময় হলেই যাব।
প্রফুল্ল। তাই যাবেন। যাই হোক দাদা, আপনার যাবার সময়ের তবু একটা আন্দাজ পাওয়া গেল, কিন্তু আমার যাবার সময় যে কবে আসবে তার কূল-কিনারাও চোখে পড়ে না।
[এককড়ির প্রবেশ]
এককড়ি। মিস্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। পুলের কাজটা কোথা থেকে আরম্ভ হবে জানতে চায়।
জীবানন্দ। চল না প্রফুল্ল, একবার মাঠে গিয়ে তাদের কাজটা দেখিয়ে আসি গে।
প্রফুল্ল। চলুন।
[জীবানন্দ প্রফুল্লকে লইয়া বাহির হইয়া গেলেন। অন্যদিক দিয়া শিরোমণি ও জনার্দন রায় প্রবেশ করিলেন]
জনার্দন। বাবু গেলেন কোথায় এককড়ি?
এককড়ি। মিস্ত্রীকে দেখাতে গেলেন। মাঠে সাঁকো তৈরি হবে।
জনার্দন। পাগলের খেয়াল।
শিরোমণি। মদ্যপান-জনিত বুদ্ধি-বিকৃতি।
এককড়ি। এই শনিবারে হাকিম সরজমিন-তদন্তে আসবেন। ছোটলোক ব্যাটাদের বুদ্ধি এবং টাকা কে যোগাচ্চে ঠিক জানতে পারলাম না, কিন্তু এইটুকু জানতে পারলাম তারা সাক্ষী মানলে হুজুর গোপন কিছুই করবেন না। দলিল তৈরির কথা পর্যন্ত না।
জনার্দন। (সহাস্যে) আমার বয়সটা কত হয়েচে ঠাওরাও এককড়ি? চণ্ডীগড়ের জনার্দন রায়কে ও-ধাপ্পায় কাত করা যাবে না, বাপু, আর কোন মতলব ভেঁজে এসো গো। (একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া) তবে, এ কথা মানি তোমার হাতে গিয়ে একটু পড়েচি। মোচড় দিয়ে দু’পয়সা উপরি রোজগারের সময় এই বটে। কিন্তু তাই বলে যা রয় সয় কর।
এককড়ি। সত্যি বলচি আপনাকে রায়মশায়—
জনার্দন। আহা, সত্যিই ত বলচ! এককড়ি নন্দী আবার মিথ্যে কবে বলেন? সে কথা নয় ভায়া, আমার না হয় শ’খানেক বিঘের টান ধরবে, কিন্তু তাঁর নিজের যাবে কত? সেটা কি তোমার মনিব খতিয়ে দেখেন নি? না দেখে থাকেন ত দেখাও গে চোখে আঙুল দিয়ে। তারপরে না হয় আমাকে প্যাঁচ ক’ষো।
এককড়ি। জায়গা-জমির কথাই হচ্চে না রায়মশাই, কথা হচ্চে দলিলপত্র তৈরি করার। জিজ্ঞাসা করলে সমস্তই বলবেন, কিছুই গোপন করবেন না।
জনার্দন। তার হেতু? শ্রীঘরে যাবার বাসনা ত? কিন্তু একা জনার্দন যাবে না এককড়ি, মহারানী হুজুর বলে রেয়াত করবে না, কথাটা তাঁকে ব’লো।
এককড়ি। (অভিমান-সুরে) বলতে হয় আপনি নিজেই বলবেন।
জনার্দন। বলব বৈ কি হে। ভালো করেই বলব। হাকিমের কাছে কবুল জবাব দিয়ে সাধু সাজা ঠাট্টা-তামাশা নয়। (ইঙ্গিতে দেখাইয়া) হাতকড়ি পড়বে।
এককড়ি। সে-আপনি বুঝবেন আর তিনি বুঝবেন।
জনার্দন। আর তুমি? শ্রীমান এককড়ি নন্দী? বাড়ি যখনি পুড়েছে তখনি জানি কি-একটা ভেতরে হচ্চে। কিন্তু জনার্দনকে অত নরম মাটি ঠাউরো না ভায়া, পস্তাবে। নির্মলকে আটকে রেখেচি, সে-ই তোমাদের বুঝিয়ে দেবে। এককড়ি। আমার ওপরে মিথ্যে রাগ করচেন রায়মশায়, যা জানি তাই শুধু জানিয়েচি। বিশ্বাস না হয়, হুজুর ত এই সামনের মাঠেই আছেন, একটু ঘুরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেই যান না।
জনার্দন। তাই যাব। শিরোমণিমশায়, আসুন ত?
শিরোমণি। চল না ভায়া, ভয় কিসের?
[দুই-এক পা অগ্রসর হইয়া সহসা পিছন ফিরিয়া]
শিরোমণি। (এককড়ির প্রতি) বলি, অত্যধিক মদ্যপান করে নেই ত? তা হলে না হয়—
এককড়ি। মদ তিনি খান না! (হঠাৎ কণ্ঠস্বর সংযত করিয়া) কিন্তু যেতেও আর হবে না। হুজুর নিজেই আসছেন।