ষোড়শী। তা হলে পড়ি?
[ষোড়শী নীরবে চিঠিখানি পড়িল, তাহার মুখে ভাবের একান্ত পরিবর্তন ঘটিল; জীবানন্দকে আড়াল করিয়া তাড়াতাড়ি সজল চক্ষু মুছিয়া ফেলিল]
ষোড়শী। আমি যে কুষ্ঠাশ্রমের দাসী হয়ে যাচ্চি এ খবর তুমি জানলে কি করে?
জীবানন্দ। কুষ্ঠাশ্রমের কথা অনেকেই জানে। আর তোমার কথা? আজই দেবতার স্থানে দাঁড়িয়ে যারা শপথ করে গেল, নিজের কানে শুনেও আমি যাদের চিনতে পারিনি তুমি তাদের চিনলে কি করে?
ষোড়শী। তোমার কি সংসারে আর মন নেই? সমস্ত বিলিয়ে নষ্ট করে দিয়ে কি তুমি সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে যেতে চাও নাকি?
জীবানন্দ। (সহসা উত্তেজিত হইয়া) আমি সন্ন্যাসী? মিছে কথা। আমি বাঁচতে চাই—মানুষের মত, আমি মানুষের মত বাঁচতে চাই। বাড়ি চাই, ঘর চাই, স্ত্রী চাই, সন্তান চাই—আর মরণ যেদিন আটকাতে পারব না, সেদিন তাদের চোখের উপর দিয়েই চলে যেতে চাই। কিন্তু এ প্রার্থনা জানাব আমি কার কাছে?
[গাড়োয়ানের প্রবেশ]
গাড়োয়ান। মা, শৈবালদীঘি সাত-আট কোশের পথ, এখন বার না হলে পৌঁছাতে বেলা হয়ে যাবে।
ষোড়শী। চল বাবা, যাচ্চি।
[গাড়োয়ান প্রস্থান করিল। ষোড়শী পুনরায় জীবানন্দকে প্রণাম করিয়া]
আমি চললাম।
জীবানন্দ। এখনি? এত রাত্রে?
ষোড়শী। প্রজারা জানে আমি ভোরবেলায় যাত্রা করব, তারা এসে পড়বার পূর্বেই আমার বিদায় হওয়া চাই।
[প্রস্থান
জীবানন্দ। (একাকী অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়াইয়া) অলকা! অলকা! একদিন তোমার মা আমার হাতে তোমাকে দিয়েছিলেন; তবু তোমাকে পেলাম না; কিন্তু সেদিন আমাকে যদি কেউ তোমার হাতে সঁপে দিতেন, আজ বোধ হয় তুমি অন্ধকারে আমাকে এমন করে ফেলে যেতে পারতে না।
[বাহির হইতে গরুর গাড়ি চালানোর শব্দ শুনা যাইতে লাগিল]
ষোড়শী – ৪.১
চতুর্থ অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
শান্তিকুঞ্জ
[জমিদারের ‘শান্তিকুঞ্জ’ তিন-চারিদিন হইল ভস্মীভূত হইয়াছে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের বহু চিহ্ন তখনও বিদ্যমান। সবই পুড়িয়াছে, মাত্র ভৃত্যদের খান-দুই ঘর রক্ষা পাইয়াছে। ইহার মধ্যেই জীবানন্দ আশ্রয় লইয়াছেন। সম্মুখের খোলা জানালা দিয়া বারুই নদীর জল দেখা যাইতেছে; প্রভাতবেলায় সেইদিকে চোখ মেলিয়া জীবানন্দ নিঃশব্দে বসিয়াছিলেন। মুখে চাঞ্চল্য বা উত্তেজনার কোন প্রকাশ নাই, শুধু সারারাত্রি ধরিয়া উৎকট রোগ-ভোগের একটা অবসন্ন ম্লান ছায়া তাঁহার সর্বদেহে পরিব্যাপ্ত হইয়া আছে]
[প্রফুল্ল প্রবেশ করিল]
প্রফুল্ল। এখন কেমন আছেন দাদা?
জীবানন্দ। ভালো আছি।
প্রফুল্ল। বহুকালের অভ্যাস, ওষুধ বলেও যদি এক-আধ আউন্স—
জীবানন্দ। (সহাস্যে) ওষুধই বটে। না প্রফুল্ল, মদ আমি খাব না।
প্রফুল্ল। রাত্রিটা কাল কি উৎকণ্ঠাতেই আমাদের কেটেছে। যন্ত্রণায় হাত-পা পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল।
জীবানন্দ। তাই এই গরম করার প্রস্তাব?
প্রফুল্ল। বল্লভ ডাক্তারের ভয়, হয়ত হঠাৎ হার্টফেল করতে পারে।
জীবানন্দ। হার্ট ত হঠাৎই ফেল করে প্রফুল্ল।
প্রফুল্ল। কিন্তু সেজন্যে ত একটা—
জীবানন্দ। (নিজের হার্ট হাত দিয়া দেখাইয়া) ভায়া, এ বেচারা বহু উপদ্রবেও সমানে চলতে কোনদিন ফেল করেনি। দৈবাৎ একদিন একটা অকাজ যদি করেই বসে ত মাপ করা উচিত।
প্রফুল্ল। কি একগুঁয়ে মানুষ আপনি দাদা। ভাবি, এতবড় জিদ এতকাল কোথায় লুকানো ছিল!
জীবানন্দ। ভালো কথা, তোমার ডালভাতের যোগাড়ে বার হবার যে একটা সাধু প্রস্তাব ছিল তার কতদূর?
প্রফুল্ল। ঘাট হয়েছে দাদা। আপনি ভালো হয়ে উঠুন, ডালভাতের চিন্তা তার পরেই করব।
জীবানন্দ। আমার ভালো হবার পরে ত? যাক তা হলে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।
[তারাদাস ও পূজারীর প্রবেশ]
তারাদাস। মন্দিরের খানকয়েক থালা-ঘটি-বাটি পাওয়া যাচ্ছে না।
জীবানন্দ। না গেলে সেগুলো আবার কিনে নিতে হবে।
[ব্যস্ত হইয়া এককড়ির প্রবেশ]
এককড়ি। (ডাক ছাড়িয়া) এ কাজ সাগর সর্দারের। আজ খবর পাওয়া গেল, তাকে আর তার দু’জন সঙ্গীকে সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত এদিকে ঘুরে বেড়াতে লোক দেখেচে। থানায় সংবাদ পাঠিয়েচি, পুলিশ এল বলে। সমস্ত ভূমিজ গুষ্টিকে যদি না আমি এই ব্যাপারে আন্দামানে পাঠাতে পারি ত আমার নামই এককড়ি নন্দী নয়—বৃথাই আমি এতকাল হুজুরের সরকারে গোলামি করে মরচি।
জীবানন্দ। (একটু হাসিয়া) তা হলে তোমাকেও ত এদের সঙ্গে যেতে হয় এককড়ি। জমিদারের গোমস্তাগিরি কাজে তুমি যাদের ঘর জ্বালিয়েছ সে ত আমি জানি। এদের আগুন দিতে কেউ চোখে দেখেনি, কেবল সন্দেহের উপর যদি তাদের শাস্তি ভোগ করতে হয়, জানা-অপরাধের জন্য তোমাকেও ত তার ভাগ নিতে হয়।
এককড়ি। (প্রথমে হতবুদ্ধি হইয়া, পরে শুষ্ক হাস্যের সহিত) হুজুর মা-বাপ। আমাদের সাত-পুরুষ হুজুরের গোলাম। হুজুরের আদেশে শুধু জেল কেন, ফাঁসি যাওয়ায় আমাদের অহঙ্কার।
জীবানন্দ। যা পুড়েছে, সে আর ফিরবে না; কিন্তু এর পর যদি পুলিশের সঙ্গে জুটে নতুন হাঙ্গামা বাধিয়ে দু’পয়সা উপরি রোজগারের চেষ্টা কর, তা হলে হুজুরের লোকসানের মাত্রা ঢের বেড়ে যাবে এককড়ি।
পূজারী। মিস্ত্রী এসেছে হুজুরের কাছে নালিশ জানাতে।
জীবানন্দ। কিসের নালিশ?
পূজারী। মন্দিরের মেরামতি-কাজে ঘটনাচক্রে তার বিশেষ লোকসান হয়ে যায়। মা বলেছিলেন, কাজ শেষ হলে তার ক্ষতিপূরণ করে দেবেন। আমি তখন উপস্থিত ছিলাম হুজুর।
জীবানন্দ। তবে দেওয়া হয় না কেন?