প্রফুল্ল। হঠাৎ হলো কি? না হয়, পাইকদের কাউকে ডেকে দিই?
জীবানন্দ। না, পাইক-পেয়াদা আর নয়। তোমরা বাড়ি যাও।
প্রফুল্ল। আপনার অবাধ্য হবো না দাদা, আমরা চললাম, কিন্তু আপনিও বেশী বিলম্ব করবেন না আমার অনুরোধ।
[প্রফুল্ল ও বেয়ারা প্রস্থান করিল
[জীবানন্দ ধীরে ধীরে নাটমন্দিরের আর একটা দিকে আসিয়া উপস্থিত হইল। একজন থাম ঠেস দিয়া বসিয়া মৃদুকণ্ঠে নাম-গান করিতেছিল এবং অদূরে চার-পাঁচজন লোক চাদর মুড়ি দিয়া ঘুমাইতেছিল। জীবানন্দ হেঁট হইয়া অন্ধকারে তাহাকে দেখিবার চেষ্টা করিল]
গীত
পূজা করে তোরে তারা
সার যদি হয় নয়নধারা,
শুভঙ্করী নাম তবে মা
ধরিস কেন দুঃখ-হরা।
কি পাপেতে বল্ মা কালী
মাখালি কলঙ্ক-কালি—
এখন ভরসা কেবল কালী
তুই মা বরাভয়-করা।
জীবানন্দ। তুমি কে হে?
পথিক। আজ্ঞে, আমি একজন যাত্রী বাবু।
জীবানন্দ। বাবু বলে আমাকে চিনলে কি করে?
পথিক। আজ্ঞে, তা আর চেনা যায় না? ভদ্দরলোক ছাড়া এমন ধপধপে কাপড় আর কাদের থাকে বাবু?
জীবানন্দ। ওঃ—তাই বটে! কোথা থেকে আসচ? কোথায় যাবে? এরা বুঝি তোমার সঙ্গী?
পথিক। আসচি মানভূম জেলা থেকে বাবু, যাব পুরীধামে। এদের কারও বাড়ি মেদিনীপুরে, কারও বাড়ি আর কোথাও—কোথায় যাবে তাও জানিনে।
জীবানন্দ। আচ্ছা, কত লোক এখানে রোজ আসে? যারা থাকে তারা দু’বেলা খেতে পায়, না?
পথিক। (লজ্জিত হইয়া) কেবল খাবার জন্যেই নয় বাবু! আমার পা কেটে গিয়ে ঘায়ের মত হয়েছে দেখেই মা-ভৈরবী নিজে হুকুম দিয়েছিলেন যত দিন না সারে তুমি থাকো।
জীবানন্দ। তোমাকে যেতে বলিনি ভাই, বেশ ত থাকো না। জায়গার ত আর অভাব নেই।
পথিক। কিন্তু ভৈরবী মা ত আর নেই শুনতে পেলাম।
জীবানন্দ। এরই মধ্যে শুনতে পেয়েছ? তা নাই তিনি থাকলেন, তাঁর হুকুম ত আছে? তোমাকে যেতে বলে কার সাধ্য? বাড়ি কোথায় তোমার ভাই?
পথিক। বাড়ি আমার ছিল বাবু মানভুঁয়ের বংশীতট গাঁয়ে। গাঁয়ে অন্ন নেই, জল নেই, ডাক্তার-বদ্যি নেই—জমিদার থাকেন কলকাতায়, কখনো তাঁকে কেউ দুঃখ জানাতে পারিনে। আছে শুধু গোমস্তা টাকা আদায়ের জন্যে।
[জীবানন্দ নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়া সায় দিল]
পথিক। উপরি উপরি দু’সন বৃষ্টি হলো না, ক্ষেতের ফসল জ্বলে-পুড়ে গেল, এও সয়েছিল বাবু, —কিন্তু— (কান্নায় তাহার গলা বুজিয়া আসিল)
জীবানন্দ। তাই বুঝি তীর্থ-দর্শনে একবার বেরিয়ে পড়লে?
পথিক। (মাথা নাড়িয়া) এই ফাল্গুনে পরিবার মারা গেল, একে একে দুই ছেলে ওলাউঠায় চোখের সামনে মারা গেল বাবু, একফোঁটা ওষুধ কাউকে দিতে পারলাম না।
[বলিতে বলিতে লোকটি উচ্ছ্বসিত শোকে কাঁদিয়া ফেলিল। জীবানন্দ জামার হাতায় চোখ মুছিতে লাগিলেন]
পথিক। মনে মনে বললাম, আর কেন? ভাঙ্গা কুঁড়েখানি বিধবা ভাইঝিকে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম—বাবু, আমার চেয়ে দুঃখী আর সংসারে নেই।
জীবানন্দ। ওরে ভাই, সংসারটা ঢের বড় জায়গা, এর কোথায় কে কিভাবে আছে বলবার জো নেই।
পথিক। কিন্তু আমার মত—
জীবানন্দ। দুঃখী? কিন্তু দুঃখীদেরও কোন আলাদা জাত নেই দাদা, দুঃখেরও কোন বাঁধানো রাস্তা নেই। তা হলে সবাই তাকে এড়িয়ে চলতে পারত। হুড়মুড় করে যখন ঘাড়ে এসে পড়ে তখনই কেবল মানুষ টের পায়। আমার সব কথা তুমি বুঝবে না ভাই, কিন্তু সংসারে তুমি একলা নও। অন্ততঃ একজন সাথী তোমার বড় কাছেই আছে, তাকে তুমি চিনতেও পারোনি। কিন্তু তুমি মায়ের নাম করছিলে—
[সহসা সাগর ও হরিহর দ্রুতপদে প্রবেশ করিয়া মন্দিরের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। জীবানন্দ উৎকর্ণ হইয়া শুনিতে লাগিল]
হরিহর। আমাদের মায়ের সর্বনাশ যে করেছে তার সর্বনাশ না করে আমরা কিছুতেই ছাড়ব না।
সাগর। মায়ের চৌকাঠ ছুঁয়ে দিব্যি করলাম খুড়ো, ফাঁসি যেতে হয় তাও যাব।
হরিহর। হঃ—আমাদের আবার জেল, আমাদের আবার ফাঁসি! মা আগে যাক—
হরিহর ও সাগর। জয় মা চণ্ডী!
[উভয়ের প্রস্থান
জীবানন্দ। বাস্তবিক, ঠাকুর-দেবতার মত এমন সহৃদয় শ্রোতা আর নেই। হোক না মিথ্যা দম্ভ, তবু তার দাম আছে। দুর্বলের ব্যর্থ পৌরুষ তবু একটু গৌরবের স্বাদ পায়।
পথিক। কি বললেন বাবু?
জীবানন্দ। কিছু না ভাই, মায়ের নাম করছিলে আমি বাধা দিলাম। আবার শুরু কর, আমি চললাম। কাল এমনি সময়ে হয়ত আবার দেখা পাবে।
পথিক। আর ত দেখা হবে না বাবু, আমি পাঁচদিন আছি, কালই সকালে চলে যেতে হবে।
জীবানন্দ। চলে যেতে হবে? কিন্তু এই যে বললে তোমার পা এখনো সারেনি, তুমি হাঁটতে পার না?
পথিক। মায়ের মন্দির এখন রাজাবাবুর। হুজুরের হুকুম তিনদিনের বেশি আর কেউ থাকতে পারবে না।
জীবানন্দ। (হাসিয়া) ভৈরবী এখনও যায়নি, এরই মধ্যে হুজুরের হুকুম জারি হয়ে গেছে? মা-চণ্ডীর কপাল ভালো! আচ্ছা, আজ অতিথিদের সেবা হলো কিরকম? কি খেলে ভাই?
পথিক। যাদের তিনদিনের বেশি হয়নি তারা মায়ের প্রসাদ সবাই পেলে।
জীবানন্দ। আর তুমি? তোমার ত তিনদিনের বেশি হয়ে গেছে?
পথিক। ঠাকুরমশাই কি করবেন, রাজাবাবুর হুকুম নেই কিনা।
জীবানন্দ। তাই হবে। (এই বলিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচন করিল)
জীবানন্দ। কাল আমি আবার আসব, কিন্তু ভাই, চুপিচুপি চলে যেতে পাবে না।
পথিক। ঠাকুরমশাই যদি কিছু বলে?
জীবানন্দ। বললেই বা। এত দুঃখ সইতে পারলে, আর বামুনের একটা কথা সইতে পারবে না? রাত হলো এখন যাই, কিন্তু মনে থাকে যেন।