জীবানন্দ। (সহাস্যে) একেবারে নিলে? কিন্তু এইবার নিয়ে ক’বার নেওয়া হলো প্রফুল্ল?
প্রফুল্ল। বার-চারেক। (হাসিয়া ফেলিয়া) ভগবান মুখটা দিয়েছিলেন, তা বড়লোকের প্রসাদ খেয়েই দিন গেল; দুটো বড় কথাও যদি না মাঝে মাঝে বার করতে পারি ত নিতান্তই এর জাত যায়। নেহাত অপরাধও নেই দাদা। বহুকাল ধরে আপনাদের জলকে কখনো উঁচু কখনো নীচু বলে এ দেহটায় মেদ-মাংসই কেবল পরিপূর্ণ করেছি, সত্যিকারের রক্ত বলতে আর ছিটেফোঁটাও বাকী রাখিনি। আজ ভাবচি এক কাজ করব। সন্ধ্যার আবছায়ায় গা-ঢাকা দিয়ে গিয়ে খপ করে ভৈরবীঠাক্রুনের এক খামচা পায়ের ধূলো নিয়ে ফেলব। আপনার অনেক ভালো-মন্দ দ্রব্যই ত আজ পর্যন্ত উদরস্থ করেচি, এ নইলে সেগুলো আর হজম হবে না, পেটে লোহার মত ফুটবে।
জীবানন্দ। (হাসিবার চেষ্টা করিয়া) আজ উচ্ছ্বাসের কিছু বাড়াবাড়ি হচ্চে প্রফুল্ল।
প্রফুল্ল। (যুক্তহস্তে) তা হলে বসুন দাদা, এটা শেষ করি। মোসাহেবির পেন্সন বলে সেদিন যে উইলখানায় হাজার-পাঁচেক টাকা লিখে রেখেছেন, সেটার ওপরে দয়া করে একটা কলমের আঁচড় দিয়ে রাখবেন—চণ্ডীর টাকাটা হাতে এলে মোসাহেবের অভাব হবে না কিন্তু আমাকে দান করে অতগুলো টাকার আর দুর্গতি করবেন না।
জীবানন্দ। তা হলে এবার আমাকে তুমি সত্যিই ছাড়লে
প্রফুল্ল। আশীর্বাদ করুন এই সুমতিটুকু যেন শেষ পর্যন্ত বজায় থাকে। কিন্তু কবে যাচ্চেন তিনি
জীবানন্দ। জানিনে।
প্রফুল্ল। কোথায় যাচ্চেন তিনি
জীবানন্দ। তাও জানিনে।
প্রফুল্ল। জেনেও কোন লাভ নেই দাদা। বাপ রে মেয়েমানুষ ত নয় যেন পুরুষের বাবা। মন্দিরে দাঁড়িয়ে সেদিন অনেকক্ষণ চেয়েছিলাম মনে হলো পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন পাথরে গড়া। ঘা মেরে গুঁড়ো করা যাবে কিন্তু আগুনে গলিয়ে ইচ্ছে মত ছাঁচে ঢেলে গড়বেন সে বস্তুই নয়। পারেন ত ও মতলবটা পরিত্যাগ করবেন।
জীবানন্দ। বিদ্রূপের স্বরে তা হলে প্রফুল্ল এবার নিতান্তই যাচ্চো
প্রফুল্ল। গুরুজনের আশীর্বাদের জোর থাকে ত মনস্কামনা সিদ্ধ হবে বৈ কি।
জীবানন্দ। তা হতে পারে। আচ্ছা ষোড়শী সত্যই চলে যাবে তোমার মনে হয়
প্রফুল্ল। হয়। কারণ সংসারে সবাই প্রফুল্ল নয়। ভালো কথা দাদা একটা খবর দিতে আপনাকে ভুলেছিলাম। কাল রাত্রে নদীর ধারে বেড়াচ্ছিলাম হঠাৎ দেখি সেই ফকিরসাহেব। আপনাকে যিনি একদিন তাঁর বটগাছে ঘুঘু শিকার করতে দেননি—বন্দুক কেড়ে নিয়েছিলেন—তিনি। কুর্নিশ করে কুশল প্রশ্ন করলাম ইচ্ছে ছিল মুখরোচক দুটো খোশামোদ টোশামোদ করে যদি একটা কোন ভালরকমের ওষুধ টষুধ বার করে নিতে পারি ত আপনাকে ধরে পেটেন্ট নিয়ে বেচে দু’পয়সা রোজগার করব। কিন্তু ব্যাটা ভারী চালাক, সেদিক দিয়েই গেল না। কথায় কথায় শুনলাম তাঁর ভৈরবী মাকে দেখতে এসেছিলেন, এখন চলে যাচ্চেন। ভৈরবী যে সমস্ত ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্চেন তাঁর কাছেই শুনতে পেলাম।
জীবানন্দ। এঁর সদুপদেশের ফলেই বোধ হয়?
প্রফুল্ল। না। বরঞ্চ, উপদেশের বিরুদ্ধেই যাচ্চেন।
জীবানন্দ। বল কি হে, ফকির যে শুনি তাঁর গুরু! গুরু-আজ্ঞা লঙ্ঘন?
প্রফুল্ল। এক্ষেত্রে তাই বটে।
জীবানন্দ। কিন্তু এতবড় বিরাগের হেতু?
প্রফুল্ল। হেতু আপনি। কি জানি, এ কথা শোনানো আপনাকে উচিত হবে কিনা, কিন্তু ফকিরের বিশ্বাস আপনাকে তিনি মনে মনে অত্যন্ত ভয় করেন। পাছে কলহবিবাদের মধ্যে দিয়েও আপনার সঙ্গে মাখামাখি হয়ে যায়, এই তাঁর সবচেয়ে দুশ্চিন্তা। নইলে ভয় তাঁর মিথ্যা কলঙ্কেও নয়, গ্রামের লোককেও নয়।
[জীবানন্দ বিস্ফারিত চক্ষে নীরবে চাহিয়া রহিলেন]
প্রফুল্ল। দাদা, ভগবান আপনাকেও বুদ্ধি বড় কম দেননি, কিন্তু সর্বস্ব সমর্পণ করে কাল তিনিই মারাত্মক ভুল করলেন, না হাত পেতে নিয়ে আপনিই মারাত্মক ভুল করলেন, সে মীমাংসা আজ বাকী রয়ে গেল। বেঁচে থাকি ত একদিন দেখতে পাব আশা হয়।
[জীবানন্দ নিঃশব্দে বসিয়া রহিলেন। সহসা বেয়ারা পাত্র ভরিয়া মদ লইয়া প্রবেশ করিতেই]
জীবানন্দ। আঃ—এখানেও! যা নিয়ে যা—দরকার নেই।
[বেয়ারা প্রস্থান করিল
প্রফুল্ল। রাগ করেন কেন দাদা, যেমন শিক্ষা। বরঞ্চ কখন দরকার সেইটেই বলে দিন না। অকস্মাৎ অমৃতে অরুচি যে দাদা?
জীবানন্দ। (হাসিয়া) অরুচি নয়, কিন্তু আর খাব না।
প্রফুল্ল। (হাসিয়া) এই নিয়ে ক’বার হলো দাদা?
জীবানন্দ। (হাসিয়া) এই মীমাংসাটাও আজ না হয় বাকী থাক প্রফুল্ল, যদি বেঁচে থাকো ত একদিন দেখতে পাবে আশা করি।
[বেয়ারা পুনরায় প্রবেশ করিল]
বেয়ারা। এই পিস্তলটা ভুলে টেবিলের ওপর ফেলে রেখে এসেছিলেন।
জীবানন্দ। ভুলেই এসেছিলাম বটে, কিন্তু ওতেও আর কাজ নেই, তুই নিয়ে যা।
প্রফুল্ল। কিন্তু রাত প্রায় এগারোটা হলো, বাড়ি চলুন।
জীবানন্দ। না, বাড়ি নয় প্রফুল্ল, এখন একলা অন্ধকারে একটু ঘুরতে বার হবো।
প্রফুল্ল। একলা? নিরস্ত্র? না না, সে হয় না দাদা। অন্ধকার রাত, পথে-ঘাটে আপনার অনেক শত্রু। অন্ততঃ নিত্য-সহচরটিকে সঙ্গে রাখুন। (এই বলিয়া সে ভৃত্যের হাত হইতে পিস্তল লইয়া দিতে গেল)
জীবানন্দ। (পিছাইয়া গিয়া) এ জীবনে ওকে আর আমি ছুঁচ্চিনে প্রফুল্ল। আজ থেকে আমি এমনি একাকী বার হবো, যেন কোথাও কোন শত্রু নেই আমার। আমার থেকেও কারও কোন না ভয় হোক; তার পরে যা হয় তা ঘটুক, আমি কারও কাছে নালিশ করব না।