জীবানন্দ। তা করেছে। জমা-খরচের খাতাও একখানা দিয়েছে।
শিরোমণি। বেটী এখনও আছে, কিন্তু কখন কোথায় চলে যায় সে ত বলা যায় না।
জীবানন্দ। (মুহূর্তকাল বৃদ্ধের মুখের প্রতি চাহিয়া) কিন্তু সেজন্য আপনাদের উদ্বেগ কিসের? তাকে তাড়ানও ত চাই। কি বলেন রায়মশায়?
জনার্দন। দলিলপত্র, মূল্যবান তৈজসাদি, দেবীর অলঙ্কার প্রভৃতি যা-কিছু আছে গ্রামের প্রাচীন ব্যক্তিরা সমস্তই জানেন। শিরোমণিমশায় বলেছেন যে, ষোড়শী থাকতে থাকতেই সেগুলো সব মিলিয়ে দেখলে ভালো হয়। হয়ত—
জীবানন্দ। হয়ত নেই? এই না? কিন্তু না থাকলেই বা আপনারা আদায় করবেন কি করে?
জনার্দন। (হঠাৎ উত্তর খুঁজিয়া পাইলেন না। শেষে বলিলেন) কি জানেন, তবু ত জানা যাবে হুজুর।
জীবানন্দ। ত যাবে। কিন্তু শুধু শুধু জানা গিয়ে আর লাভ কি?
শিরোমণি। (প্রথম ভদ্রলোকের প্রতি অলক্ষ্যে) সেরেছে!
জনার্দন। কিন্তু কোনদিন ত জানতেই হবে হুজুর।
জীবানন্দ। তা হবে। কিন্তু আজ আর আমার সময় নেই রায়মশাই।
শিরোমণি। (ব্যগ্র হইয়া) আমাদের সময় আছে হুজুর। চাবিটা জনার্দন ভায়ার হাতে দিলেই সন্ধ্যার পরে আমরা সমস্ত মিলিয়ে দেখতে পারি। হুজুরেরও কোনও দায়িত্ব থাকে না—কি আছে না আছে সে পালাবার আগেই সব জানা যায়। কি বল ভায়া? কি বল হে তোমরা? ঠিক বলেছি কিনা?
[সকলেই এ প্রস্তাবে সম্মতি দিল, দিল না শুধু যাহার হাতে চাবি]
জীবানন্দ। (ঈষৎ হাসিয়া) ব্যস্ত কি শিরোমণিমশায়, যদি কিছু নষ্ট হয়েই থাকে ত ভিখিরীর কাছ থেকে আর আদায় হবে না। আজ থাক, যেদিন আমার অবসর হবে আপনাদের খবর দেব।
[মনে মনে সকলেই ক্রুদ্ধ হইল]
জনার্দন। (উঠিয়া দাঁড়াইয়া) কিন্তু দায়িত্ব একটা—
জীবানন্দ। সে ত ঠিক কথা রায়মশায়। দায়িত্ব একটা আমার রইল বৈ কি।
[সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল। চলিতে চলিতে জমিদারের শ্রুতিপথের বাইরে আসিয়া]
শিরোমণি। (জনার্দনের গা টিপিয়া) দেখলে ভায়া, ব্যাটা মাতালের ভাব বোঝাই ভার। গুয়োটা কথা কয় যেন হেঁয়ালি। মদে চুর হয়ে আছে। বাঁচবে না বেশিদিন।
জনার্দন। হুঁ। যা ভয় করা গেল তাই হলো দেখচি।
শিরোমণি। এবারে গেল সব শুঁড়ির দোকানে। বেটী যাবার সময় আচ্ছা জব্দ করে গেল।
প্রথম ভদ্রলোক। হুজুর আর দিচ্চেন না।
শিরোমণি। আবার? এবার চাইতে গেলে গলা টিপে মদ খাইয়ে দিয়ে তবে ছাড়বে। (কথাটা উচ্চারণ করিয়াই তাঁহার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল)
[সকলের প্রস্থান
প্রফুল্ল। (খবরের কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া) দাদা, আবার একটা নূতন হাঙ্গামা জড়ালেন কেন? চাবিটা ওদের দিয়ে দিলেই ত হতো।
জীবানন্দ। হতো না প্রফুল্ল, হলে দিতাম। পাছে এই দুর্ঘটনা ঘটে বলেই সে কাল রাতে আমার হাতে চাবি দিয়েছে।
প্রফুল্ল। সিন্দুকে আছে কি?
জীবানন্দ। (হাসিয়া) কি আছে? আজ সকালে তাই আমি খাতাখানা পড়ে দেখলাম। আছে মোহর, টাকা, হীরে, পান্না, মুক্তোর মালা, মুকুট, নানা রকমের জড়োয়া গয়না, কত কি দলিলপত্র, তা ছাড়া সোনা-রূপার বাসন-কোসনও কম নয়। কতকাল ধরে জমা হয়ে এই ছোট্ট চণ্ডীগড়ের ঠাকুরের যে এত সম্পত্তি সঞ্চিত আছে, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। চুরি-ডাকাতের ভয়ে ভৈরবীরা বোধ করি কাউকে জানতেও দিত না।
প্রফুল্ল। (সভয়ে) বলেন কি! তার চাবি আপনার কাছে? একমাত্র পুত্র-সমর্পণ ডাইনীর হাতে?
জীবানন্দ। নিতান্ত মিথ্যে বলনি ভায়া, এত টাকা দিয়ে আমি নিজেকেও বিশ্বাস করতে পারতাম না অথচ এ আমি চাইনি। যতই তাকে পীড়াপীড়ি করলাম, জনার্দনকে দিতে, ততই সে অস্বীকার করে আমার হাতে গুঁজে দিলে।
প্রফুল্ল। এর কারণ?
জীবানন্দ। বোধ হয় সে ভেবেছিল এ দুর্নামের ওপর আবার চুরির কলঙ্ক চাপালে তার আর সইবে না। এদের সে চিনেছিল।
প্রফুল্ল। কিন্তু আপনাকে সে চিনতে পারেনি।
জীবানন্দ। (হাসিল, কিন্তু সে হাসিতে আনন্দ ছিল না) সে দোষ তার, আমার নয়। তার সম্বন্ধে অপরাধ আর যত দিকেই করে থাকি প্রফুল্ল, আমাকে চিনতে না দেওয়ার অপরাধ করিনি। কিন্তু আশ্চর্য এই পৃথিবী, এবং তার চেয়েও আশ্চর্য এর মানুষের মন। এ যে কি থেকে কি স্থির করে নেয় কিছুই বলবার জো নেই। এর যুক্তিটা কি জানো ভায়া, সেই যে তার হাত থেকে একদিন মরফিয়া চেয়ে নিয়ে চোখ বুজে খেয়েছিলাম, সেই হলো তার সকল তর্কের বড় তর্ক—সকল বিশ্বাসের বড় বিশ্বাস। কিন্তু সে রাত্রে আর যে কোন উপায় ছিল না—সে ছাড়া যে আর কারও পানে চাইবার কোথাও কেউ ছিল না—এ-সব ষোড়শী একেবারে ভুলে গেছে। কেবল একটি কথা তার মনে জেগে আছে—যে নিজের প্রাণটা অসংশয়ে তার হাতে দিতে পেরেছিল তাকে আবার অবিশ্বাস করা যায় কি করে! ব্যস্ যা কিছু ছিল চোখ বুজে দিলে আমার হাতে তুলে। প্রফুল্ল, দুনিয়ায় ভয়ানক চালাক লোকেও মাঝে মাঝে মারাত্মক ভুল করে বসে, নইলে সংসারটা একেবারে মরুভূমি হয়ে যেত, কোথাও রসের বাষ্পটুকু জমবারও ঠাঁই পেত না।
প্রফুল্ল। অতিশয় খাঁটি কথা দাদা! অতএব অবিলম্বে খাতাখানা পুড়িয়ে ফেলে তারাদাস ঠাকুরকে ডেকে ধমক দিন—জমানো মোহরগুলোয় যদি সলোমন সাহেবের দেনাটা শোধ যায় ত শুধু রসের বাষ্প কেন, মুষলধারে বর্ষণ শুরু হতে পারবে।
জীবানন্দ। প্রফুল্ল, এই জন্যেই তোমাকে এত পছন্দ করি।
প্রফুল্ল। (হাত জোড় করিয়া) এই পছন্দটা এইবার একটু খাটো করতে হবে দাদা। রসের উৎস আপনার অফুরন্ত হোক, কিন্তু মোসাহেবি করে এ অধীনের গলার চুঙ্গিটা পর্যন্ত কাঠ হয়ে গেছে। এইবার একবার বাইরে গিয়ে দুটো ডালভাতের যোগাড় করতে হবে। কাল-পরশু আমি বিদায় নিলাম।