ষোড়শী। জবাব খুঁজে পাইনে। হঠাৎ বিস্ময় লাগে এ কি আপনার কথা!
জীবানন্দ। তবে এই কথাটা বল, সেখানে তোমার চলবে কি করে?
ষোড়শী। অত্যন্ত অনাবশ্যক কৌতূহল চৌধুরীমশায়।
জীবানন্দ। তাই বটে, অলকা তাই বটে। আজ আমার আবশ্যক-অনাবশ্যক তোমাকে বোঝাব আমি কি দিয়ে!
[বাহিরে পূজারীর কাশি ও পায়ের শব্দ শুনা গেল। অতঃপর তিনি প্রবেশ করিলেন]
পূজারী। মা, সকলের সম্মুখে মন্দিরের চাবিটা আমি তারাদাস ঠাকুরের হাতেই দিলাম। রায়মশায়, শিরোমণি—এঁরা উপস্থিত ছিলেন।
ষোড়শী। ঠিকই হয়েছে। তুমি একটু দাঁড়াও, আমি সাগরের ওখানে একবার যাব।
জীবানন্দ। এগুলোও তা হলে তুমি রায়মশায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়ো।
ষোড়শী। না, সিন্দুকের চাবি আর কারও হাতে দিয়ে আমার বিশ্বাস হবে না।
জীবানন্দ। তবে কি বিশ্বাস হবে শুধু আমাকেই?
[ষোড়শী কোন উত্তর না দিয়া জীবানন্দের পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিল। উঠিয়া দাঁড়াইয়া বিস্ময়ে অভিভূত পূজারীকে কহিল]
ষোড়শী। চল বাবা, আর দেরি করো না।
পূজারী। চল, মা চল।
[পূজারী ও ষোড়শী প্রস্থান করিলে একাকী জীবানন্দ সেই জনহীন কুটীর-অঙ্গনে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল]
ষোড়শী – ৩.১
তৃতীয় অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
নাটমন্দির
[চণ্ডীর প্রাঙ্গণস্থিত নাটমন্দিরের একাংশ। সময়—অপরাহ্ন। উপস্থিত—শিরোমণি, জনার্দন রায় এবং আরও দুই-চারিজন গ্রামের ভদ্রব্যক্তি]
শিরোমণি। (আশীর্বাদের ভঙ্গিতে ডান হাত তুলিয়া জনার্দনের প্রতি) আশীর্বাদ করি দীর্ঘজীবী হও, ভায়া, সংসারে এসে বুদ্ধি ধরেছিলে বটে।
জনার্দন। (হেঁট হইয়া পদধূলি লইয়া) আজ এই নিয়ে নির্মলকে দুটো তিরস্কার করতে হলো, শিরোমণিমশাই, মনটা তেমন ভালো নেই।
শিরোমণি। না থাকবারই কথা। কিন্তু এ একপ্রকার ভালই হলো ভায়া। এখন বাবাজীর চৈতন্যোদয় হবে যে, শ্বশুর এবং পিতৃব্যস্থানীয়দের বিরুদ্ধাচরণ করার প্রত্যবায় আছে। আর, এ যে হতেই হবে। সর্বমঙ্গলময়ী চণ্ডীমাতার ইচ্ছা কিনা!
প্রথম ভদ্রলোক। সমস্তই মায়ের ইচ্ছা। তা নইলে কি ষোড়শী ভৈরবী বিনা বাক্যব্যয়ে চলে যেতে চায়!
শিরোমণি। নিঃসন্দেহ। মন্দিরের চাবিটা ত পূজারীর কাছ থেকে কৌশলে আদায় হয়েছে, কিন্তু আসল চাবিটা শুনচি নাকি গিয়ে পড়েছে জমিদারের হাতে। ব্যাটা পাঁড় মাতাল, দেখো ভায়া, শেষকালে মায়ের সিন্দুকের সোনারূপো না ঢুকে যায় শুঁড়ির সিন্দুকে। পাপের আর অবধি থাকবে না।
জনার্দন। ঐটে খেয়াল করা হয়নি।
শিরোমণি। না, এখন সহজে দিলে হয়। দশদিন পরে হয়ত বলে বসবে, কৈ, কিছুই ত সিন্দুকে ছিল না! কিন্তু আমরা সবাই জানি ভায়া, ষোড়শী আর যাই কেন না করুক, মায়ের সম্পত্তি অপহরণ করবে না—একটি পাই-পয়সা না।
[অনেকেই এ কথা স্বীকার করিল]
দ্বিতীয় ভদ্রলোক। এর চেয়ে বরঞ্চ সে-ই ছিল ভাল।
শিরোমণি। চাবিটা অবিলম্বে উদ্ধার করা চাই।
অনেকে। চাই চাই—অবিলম্বে চাই।
প্রথম ভদ্রলোক। আমি বলি, চলুন, আমরা দল বেঁধে যাই জমিদারের কাছে। বলি গে, চাবিটা দিন, কি আছে না আছে মিলিয়ে দেখি গে।
দ্বিতীয় ভদ্রলোক। আমিও তাই বলি।
প্রথম ভদ্রলোক। আজ বেলা তৃতীয় প্রহরে—হুজুর ঘুমটি থেকে উঠে মদ খেতে বসেছেন, মেজাজ খুশ্ আছে—ঠিক এমনি সময়টিতে।
অনেকে। ঠিক ঠিক, এই ঠিক মতলব।
শিরোমণি। (সভয়ে) কিন্তু অত্যন্ত মদ্যপান করে থাকলে যাওয়া সঙ্গত হবে না। কি বল জনার্দন?
[অকস্মাৎ ইঁহাদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল। কে একজন কহিল, ‘স্বয়ং হুজুর আসচেন যে!’ পরক্ষণেই জীবানন্দ ও প্রফুল্ল প্রবেশ করিলেন। যাহারা বসিয়াছিল অভ্যর্থনা করিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। জীবানন্দ নাটমন্দিরে উঠিবার সিঁড়ির উপরে বসিতে যাইতেছিলেন, সকলে সমস্বরে বলিয়া উঠিল, ‘আসন, আসন, শীঘ্র একটা আসন নিয়ে এস’]
জীবানন্দ। (উপবেশন করিয়া) আসনের প্রয়োজন নেই।—দেবীর মন্দির, এর সর্বত্রই ত আসন বিছানো।
জনার্দন। তাতে আর সন্দেহ কি! কিন্তু এ আপনারই যোগ্য কথা।
[প্রফুল্ল সিঁড়ির একাংশে গিয়া বসিল, এবং হাতে তাহার যে খবরের কাগজখানা ছিল তাহাই খুলিয়া নিঃশব্দে পড়িতে লাগিল]
শিরোমণি। যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী। মেঘ না চাইতে জল। আজই দ্বিপ্রহরে আমরা হুজুরের কাছে যাব স্থির করেছিলাম, কিন্তু পাছে নিদ্রার ব্যাঘাত হয় এইজন্যেই—
জীবানন্দ। যাননি? কিন্তু হুজুর ত দিনের বেলা নিদ্রা দেন না।
শিরোমণি। কিন্তু আমরা যে শুনি হুজুর—
জীবানন্দ। শোনেন? তা আপনারা অনেক কথা শোনেন, যা সত্য নয় এবং অনেক কথা বলেন, যা মিথ্যা। এই যেমন, আমার সম্বন্ধে ভৈরবীর কথাটা—
[এই বলিয়া বক্তা হাস্য করিলেন, কিন্তু শ্রোতার দল থতমত খাইয়া একেবারে মুষড়িয়া গেল]
জনার্দন। মন্দির-সংক্রান্ত গোলযোগ যে এত সহজে নিষ্পত্তি করতে পারা যাবে তা আশা ছিল না। নির্মল যে-রকম বেঁকে দাঁড়িয়েছিল—
জীবানন্দ। তিনি সোজা হলেন কি প্রকারে?
শিরোমণি। (খুশী হইয়া সদর্পে) সমস্তই মায়ের ইচ্ছা হুজুর, সোজা যে হতেই হবে। পাপের ভার তিনি আর বইতে পারছিলেন না।
জীবানন্দ। তাই হবে। তার পরে?
শিরোমণি। কিন্তু পাপ ত দূর হলো, এখন,—বল না জনার্দন, হুজুরকে সমস্ত বুঝিয়ে বল না।
জনার্দন। (চকিত হইয়া) মন্দিরের চাবি ত আমরা দাঁড়িয়ে থেকেই তারাদাস ঠাকুরকে দিইয়েচি। আজ তিনি সকালে মায়ের দোর খুলেছেন, কিন্তু সিন্দুকের চাবিটা শুনতে পেলাম, ষোড়শী হুজুরের হাতে সমর্পণ করেছে।