ষোড়শী। আমার অনেক কথাই আপনাকে জানানো হয়নি, কিন্তু একদিন হয়ত সমস্তই জানতে পারবেন। কেবল একটিমাত্র মানুষ সংসারে আছেন যাঁকে সকল কথাই জানিয়েছি, সে আমার ফকিরসাহেব।
নির্মল। এ-সকল পরামর্শ বোধ হয় তিনিই দিয়েছেন?
ষোড়শী। না, তিনি এখন পর্যন্ত কিছুই জানেন নি, এবং ওই যাকে ছাড়পত্র বলচেন সে আমার একটু আগের রচনা। যিনি এ কাজে আমাকে প্রবৃত্তি দিয়েছেন, শুধু তাঁর নামটিই আমি সংসারে সকলের কাছে গোপন রাখব।
জীবানন্দ। মনে হচ্ছে যেন ডেকে এনে আমার সঙ্গে কি একটা প্রকাণ্ড তামাশা করচ ষোড়শী। এ বিশ্বাস করা যেন সেই ‘মরফিয়া’ খাওয়ার চেয়েও শক্ত ঠেকচে।
নির্মল। (হাসিয়া জীবানন্দের প্রতি চাহিয়া) আপনি তবু এই কয়েক পা মাত্র হেঁটে এসে তামাশা দেখচেন, কিন্তু আমাকে কাজকর্ম, বাড়ি-ঘর ফেলে রেখে এই তামাশা দেখতে হচ্ছে।
আর এ যদি সত্য হয় ত আপনি যা চেয়েছিলেন সেটা অন্ততঃ পেয়ে গেলেন কিন্তু আমার ভাগ্যে ষোল আনাই লোকসান। (ষোড়শীকে) বাস্তবিক এ সকল ত আপনার পরিহাস নয়?
ষোড়শী। না নির্মলবাবু, আমার এবং আমার মায়ের কুৎসায় দেশ ছেয়ে গেল, এই কি আমার হাসি-তামাশার সময়? আমি সত্য সত্যই অবসর নিলাম।
নির্মল। তা হলে বড় দুঃখে পড়েই এ কাজ আপনাকে করতে হলো। আমি আপনাকে বাঁচাতেও হয়ত পারতাম, কিন্তু কেন যে তা হতে দিলেন না তা আমি বুঝেছি। বিষয় রক্ষা হতো, কিন্তু কুৎসার ঢেউ তাতে উত্তাল হয়ে উঠত। সে থামাবার সাধ্য আমার ছিল না। (এই বলিয়া সে কটাক্ষে জীবানন্দের প্রতি চাহিল)
নির্মল। এখন তা হলে কি করবেন স্থির করেছেন?
ষোড়শী। সে আপনাকে আমি পরে জানাব।
নির্মল। কোথায় থাকবেন?
ষোড়শী। এ খবরও আপনাকে আমি পরে দেব।
নির্মল। (হাতঘড়ি দেখিয়া) রাত প্রায় দশটা। আচ্ছা, এখন আমি তা হলে, —আমাকে আর বোধ হয় কোন আবশ্যক নেই?
ষোড়শী। এতবড় অহঙ্কারের কথা কি বলতে পারি নির্মলবাবু? তবে মন্দির নিয়ে আর বোধ হয় আমার কখনো আপনাকে দুঃখ দেবার প্রয়োজন হবে না।
নির্মল। আমাদের শীঘ্র ভুলে যাবেন না আশা করি?
ষোড়শী। (মাথা নাড়িয়া) না।
নির্মল। হৈম আপনাকে বড় ভালবাসে। যদি অবকাশ পান মাঝে মাঝে একটা খবর দেবেন।
[নির্মল প্রস্থান করিল
জীবানন্দ। ভদ্রলোকটিকে ঠিক বুঝতে পারলাম না।
ষোড়শী। না পারলেও আপনার ক্ষতি হবে না।
জীবানন্দ। আমার না হোক তোমার ত হতে পারে। মনে রাখবার জন্যে কি ব্যাকুল প্রার্থনাই জানিয়ে গেলেন।
ষোড়শী। সে শুনেছি। কিন্তু আমি তাঁকে যতখানি জানি তার অর্ধেকও আমাকে জানলে আজ এতবড় বাহুল্য আবেদন তাঁর করতে হতো না।
জীবানন্দ। অর্থাৎ?
ষোড়শী। অর্থাৎ এই যে চণ্ডীগড়ের ভৈরবী-পদ অনায়াসে জীর্ণবস্ত্রের মত ত্যাগ করে যাচ্ছি সে শিক্ষা কোথায় পেলাম জানেন? ওঁদের কাছে। মেয়েমানুষের কাছে এ যে কত ফাঁকি, কত মিথ্যে, সে বুঝেছি কেবল হৈমকে দেখে। অথচ এর বাষ্পও কোনদিন তাঁরা জানতে পারবেন না।
জীবানন্দ। তথাপি এ হেঁয়ালি হেঁয়ালিই রয়ে গেল অলকা। একটা কথা স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করতে আমার ভারী লজ্জা করে; কিন্তু যদি পারতাম, তুমি কি তার সত্য জবাব দিতে পারতে?
ষোড়শী। (সহাস্যে) আপনি যদি কোন একটা আশ্চর্য কাজ করতে পারতেন, তখন আমিও তেমনি কোন একটা অদ্ভুত কাজ করতে পারতাম কিনা, এ আমি জানিনে—কিন্তু আশ্চর্য কাজ করবার আপনার প্রয়োজন নেই—আমি বুঝেছি। অপবাদ সকলে মিলে দিয়েছে বলেই তাকে সত্য করে তুলতে হবে তার অর্থ নেই। আমি কিছুর জন্যেই কখনো কারও আশ্রয় গ্রহণ করব না। আমার স্বামী আছেন, কোন লোভেই সে কথা আমি ভুলতে পারব না। এই ভয়ানক প্রশ্নটাই না আপনাকে লজ্জা দিচ্ছিল চৌধুরীমশাই?
জীবানন্দ। তুমি আমাকে চৌধুরীমশাই বল কেন?
ষোড়শী। তবে কি বলব? হুজুর?
জীবানন্দ। না। অনেকে যা বলে ডাকে—জীবানন্দবাবু।
ষোড়শী। বেশ, ভবিষ্যতে হবে। কিন্তু রাত্রি হয়ে যাচ্চে আপনি বাড়ি গেলেন না? আপনার লোকজন কৈ?
জীবানন্দ। আমি তাদের পাঠিয়ে দিয়েচি।
ষোড়শী। একলা বাড়ি যেতে আপনার ভয় করবে না?
জীবানন্দ। না, আমার পিস্তল আছে।
ষোড়শী। তবে তাই নিয়ে বাড়ি যান, আমার ঢের কাজ আছে।
জীবানন্দ। তোমার থাকতে পারে, কিন্তু আমার নেই। আমি এখন যাব না।
ষোড়শী। (প্রখর চোখে, অথচ শান্তস্বরে) আমি লোক ডেকে আপনার সঙ্গে দিচ্চি, তারা বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে।
জীবানন্দ। (অপ্রতিভ হইয়া) ডাকতে কাউকে হবে না, আমি আপনিই যাচ্ছি। যেতে আমার ইচ্ছে হয় না। তাই শুধু আমি বলছিলাম। তুমি কি সত্যই চণ্ডীগড় ছেড়ে চলে যাবে অলকা?
ষোড়শী। (ঘাড় নাড়িয়া) হাঁ।
জীবানন্দ। কবে যাবে?
ষোড়শী। কি জানি, হয়ত কালই যেতে পারি।
জীবানন্দ। কাল? কালই যেতে পার? (একান্ত স্তব্ধ রহিয়া) আশ্চর্য! মানুষের নিজের মন বুঝতেই কি ভুল হয়! যাতে তুমি যাও সেই চেষ্টাই প্রাণপণে করেছি—অথচ, তুমি চলে যাবে শুনে চোখের সামনে সমস্ত দুনিয়াটা যেন শুকনো হয়ে গেল। তোমাকে তাড়াতে পারলে, ওই যে জমিটা দেনার দায়ে বিক্রি করেছি সে নিয়ে আর গোলমাল হবে না—কতকগুলো নগদ টাকাও হাতে এসে পড়বে, আর, —আর তোমাকে যা হুকুম করব তাই তুমি করতে বাধ্য হবে, এই দিকটাই কেবল দেখতে পেয়েছি। কিন্তু আরও যে একটা দিক আছে, স্বেচ্ছায় তুমি সমস্ত ত্যাগ করে আমার মাথাতেই বোঝা চাপিয়ে দিলে সে ভার বইতে পারব কিনা, এ কথা আমার স্বপ্নেও মনে হয়নি। আচ্ছা অলকা, এমন ত হতে পারে আমার মত তোমারও ভুল হচ্ছে, —তুমিও নিজের মনের ঠিক খবরটি পাওনি! জবাব দাও না যে?