[ফকিরের প্রস্থান
সাগর। সন্ন্যাসী ফকির তুমি, জানো না ডাকাতের বুকের জ্বালা। আমাদের সব গেছে, এর ওপর মা-ও যদি ছেড়ে যায় আমরা বাকী কিছুই রাখব না।
[প্রস্থান
[নির্মল ও ষোড়শীর প্রবেশ]
ষোড়শী। ডেকে নিয়ে এলাম সাধে! ছি, ছি, কি দাঁড়িয়ে যা তা শুনছিলেন বলুন ত! দেবীর মন্দিরে, তার উঠানের মাঝখানে জটলা করে কতকগুলো কাপুরুষ মিলে বিচারের ছলনায় দুজন অসহায় স্ত্রীলোকের কুৎসা রটনা করচে, —তাও আবার একজন মৃত, আর একজন অনুপস্থিত। আসুন আমার ঘরে।
[দুয়ারে আসন পাতা ছিল, নির্মলকে সমাদর করিয়া তাহাতে বসাইয়া ষোড়শী নিজে অদূরে উপবেশন করিল]
ষোড়শী। আপনি নাকি বলেছেন আমার মামলা-মকদ্দমার সমস্ত ভার নেবেন। এ কি সত্যি?
নির্মল। হাঁ, সত্যি।
ষোড়শী। কিন্তু কেন নেবেন?
নির্মল। বোধ হয় আপনার প্রতি অত্যাচার হচ্চে বলে।
ষোড়শী। কিন্তু আর কিছু বোধ করেন না ত? (এই বলিয়া সে মুচকিয়া হাসিল) থাক, সব কথার যে জবাব দিতেই হবে এমন কিছু শাস্ত্রের অনুশাসন নেই। বিশেষ করে এই কূট-কচালে শাস্ত্রের, না? আচ্ছা সে যাক। মকদ্দমার ভার যেন নিলেন, কিন্তু যদি হারি তখন ভার কে নেবে? তখন পেছোবেন না ত?
নির্মল। না, তখনও না।
ষোড়শী। ইস! পরোপকারের কি ঘটা! (হাসিয়া) আমি কিন্তু হৈম হলে এইসব পরোপকার-বৃত্তি ঘুচিয়ে দিতাম। অত ভালমানুষই নই—আমার কাছে ফাঁকি চলত না। রাত্রি-দিন চোখে চোখে রেখে দিতাম।
নির্মল। (বিস্ময়ে, ভয়ে, আনন্দে) চোখে চোখে রাখলেই কি রাখা যায় ষোড়শী? এর বাঁধন যেখানে শুরু হয় চোখের দৃষ্টি যে সেখানে পৌঁছায় না, এ কথা কি আজও জানতে পারনি তুমি।
ষোড়শী। পেরেছি বৈ কি। (হাসিল; বাহিরের শব্দ শুনিয়া গলা বাড়াইয়া চাহিয়া) এই যে ইনি এসেছেন।
নির্মল। কে? ফকিরসাহেব?
ষোড়শী। না, জমিদারবাবু। বলেছিলাম সভা ভাঙলে যাবার পথে আমার কুঁড়েতে একবার একটু পদধূলি দিতে। তাই দিতেই বোধ হয় আসচেন।
নির্মল। (বিরক্তি ও সঙ্কোচে আড়ষ্ট হইয়া) তা হলে আপনি আমাকে এ কথা বলেন নি কেন?
ষোড়শী। বেশ! একবার ‘তুমি’ একবার ‘আপনি’! (হাসিয়া) ভয় নেই, উনি ভারী ভদ্রলোক; লড়াই করেন না। তা ছাড়া আপনাদের পরিচয় নেই; সেটাও একটা লাভ। (দ্বারের নিকটে অগ্রসর হইয়া অভ্যর্থনা করিয়া) আসুন।
জীবানন্দ। (প্রবেশ করিয়াই থমকিয়া দাঁড়াইয়া) ইনি? নির্মলবাবু বোধ হয়।
ষোড়শী। হাঁ, আপনার বন্ধু বলে পরিচয় দিলে খুব সম্ভব অতিশয়োক্তি হবে না।
জীবানন্দ। (হাসিয়া) বিলক্ষণ! বন্ধু নয় ত কি? ওঁদের কৃপাতেই ত টিকে আছি, নইলে মামার জমিদারি পাওয়া পর্যন্ত যে-সব কীর্তি করা গেছে তাতে চণ্ডীগড়ের শান্তিকুঞ্জের বদলে ত এতদিন আন্দামানের শ্রীঘরে গিয়ে বসবাস করতে হতো।
ষোড়শী। চৌধুরীমশাই, উকিল-ব্যারিস্টার বড়লোক বলে বাহবাটা কি একা ওঁরাই পাবেন। আন্দামান প্রভৃতি বড় ব্যাপারে না হোক, কিন্তু ছোটো বলে এদেশের শ্রীঘরগুলোও ত মনোরম স্থান নয়—দুঃখী বলে ভৈরবীরা কি একটু ধন্যবাদ পেতেও পারে না?
জীবানন্দ। (অপ্রস্তুত হইয়া) ধন্যবাদ পাবার সময় হলেই পাবে।
ষোড়শী। (হাসিয়া) এই যেমন সভায় দাঁড়িয়ে এইমাত্র এক দফা দিয়ে এলেন?
[জীবানন্দ স্তব্ধ হইয়া রহিল]
ষোড়শী। নির্মলবাবু না থাকলে আজ আপনার সঙ্গে আমি ভারী ঝগড়া করতাম। ছি—এ কি কোন পুরুষের পক্ষেই সাজে? তা ছাড়া কি প্রয়োজন ছিল বলুন ত? সেদিন এই ঘরে বসেই ত আপনাকে বলেছিলাম, আপনি আমাকে যা আদেশ করবেন আমি পালন করব। আপনিও আপনার হুকুম স্পষ্ট করেই জানিয়েছিলেন। এই নিন সিন্দুকের চাবি এবং নিন হিসাবের খাতা। (অঞ্চল হইতে সিন্দুকের চাবি খুলিয়া এবং তাকের উপর হইতে একখানা খেরো-বাঁধানো মোটা খাতা পাড়িয়া জীবানন্দের পায়ের কাছে রাখিয়া দিল) মায়ের যা-কিছু অলঙ্কার, যত-কিছু দলিলপত্র সিন্দুকের ভিতরেই পাবেন, এবং আর একখানা কাগজ ঐ খাতার মধ্যে পাবেন, যাতে ভৈরবীর সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য ত্যাগ করে আমি সই করে দিয়েছি।
জীবানন্দ। (অবিশ্বাস করিয়া) বল কি! কিন্তু ত্যাগ করলে কার কাছে?
ষোড়শী। তাতেই লেখা আছে দেখতে পাবেন।
জীবানন্দ। তাই যদি হয় ত এই চাবিগুলো তাঁকেই দিলে না কেন?
ষোড়শী। তাঁকেই যে দিলাম।
জীবানন্দ। (মলিন-মুখে ও সন্দিগ্ধ-কণ্ঠে) কিন্তু এ ত আমি নিতে পারিনে ষোড়শী। খাতায় লেখা নামগুলোর সঙ্গে সিন্দুকে রাখা জিনিসগুলোও যে এক হবে, সে আমি কি করে বিশ্বাস করব? তোমার আবশ্যক থাকে তুমি পাঁচজনের কাছে বুঝিয়ে দিয়ো।
ষোড়শী। (ঘাড় নাড়িয়া) আমার সে আবশ্যক নেই। কিন্তু চৌধুরীমশায়, আপনার এ অজুহাতও অচল। চোখ বুজে যার হাত থেকে বিষ নিয়ে খাবার ভরসা হয়েছিল, তার হাত থেকে আজ চাবিটুকু নেবার সাহস নেই, এ আমি মানিনে। নিন, ধরুন। (খাতা ও চাবি তুলিয়া জীবানন্দের হাতের মধ্যে একরকম জোর করিয়া গুঁজিয়া দিল) আজ আমি বাঁচলাম। (কোমল কণ্ঠস্বরে) আর একটিমাত্র ভার আপনাকে দিয়ে যাব, সে আমার গরীব-দুঃখী প্রজাদের ভবিষ্যৎ। আমি শত ইচ্ছে করেও তাদের ভাল করতে পারিনি—আপনি অনায়াসে পারবেন। (নির্মলের প্রতি) আমার কথাবার্তা শুনে আপনি আশ্চর্য হয়ে গেছেন, না নির্মলবাবু?
নির্মল। (মাথা নাড়িয়া) শুধু আশ্চর্য নয়, আমি প্রায় অভিভূত হয়ে পড়েছি। ভৈরবীর আসন ত্যাগ করে যে আপনি ইতিমধ্যে ছাড়পত্র পর্যন্ত সই করে রেখেছেন, এ খবর ত আমাকে ঘুণাগ্রে জানান নি?