ষোড়শী। সে ত ভয়ের কথা নির্মলবাবু।
নির্মল। (সহাস্যে মাথা নাড়িয়া) ভয় একটু আছে বৈ কি!
ষোড়শী। একটু থাকা ভালো। হৈমকে সাবধান করে দেওয়া উচিত।
নির্মল। তার মানে?
ষোড়শী। মানে কি সব কথারই থাকে নাকি? (হাসিয়া) কুটুমের অভ্যর্থনা ত হলো। অবশ্য হাসি-খুশী দিয়ে যতটুকু পারি ততটুকু, —তার বেশী ত সম্বল নেই ভাই—এখন আসুন দুটো কাজের কথা কওয়া যাক।
নির্মল। বলুন।
ষোড়শী। (গম্ভীর হইয়া) দুটি লোক দেবতাকে বঞ্চিত করতে চায়। একটি রায়মশায় আর একটি জমিদার—
নির্মল। আর একটি আপনার বাবা।
ষোড়শী। বাবা? হাঁ, তিনিও বটে!
নির্মল। আমার শ্বশুরের কথা বুঝি, আপনার বাবার কথাও কতক বুঝতে পারি, কিন্তু পারিনে এই জমিদার প্রভুটিকে বুঝতে। তিনি কিসের জন্য আপনার শত্রুতা করচেন?
ষোড়শী। দেবীর অনেকখানি জমি তিনি নিজের বলে বিক্রি করে ফেলতে চান। কিন্তু আমি থাকতে ত কোনমতেই হবার জো নেই।
নির্মল। (সহাস্যে) সে আমি সামলাতে পারব।
ষোড়শী। কিন্তু আরও অনেক জিনিস আছে, যা আপনিও হয়ত সামলাতে পারবেন না।
নির্মল। কি সে-সব? একটা ত আপনার মিথ্যে দুর্নাম?
ষোড়শী। (শান্তস্বরে) সে আমি ভাবিনে। দুর্নাম সত্য হোক মিথ্যে হোক, তাই নিয়েই ত ভৈরবীর জীবন নির্মলবাবু। আমি এই কথাটাই তাঁদের বলতে চাই।
নির্মল। (সবিস্ময়ে) নিজের মুখ দিয়ে এ কথা যে স্বীকার করার সমান!
ষোড়শী। তা হবে।
নির্মল। কিন্তু ওরা যে বলে—অনেকেই বলে সে সময়ে, অর্থাৎ ম্যাজিস্ট্রেটের আসার রাত্রে আপনার কোলের উপরেই নাকি—
ষোড়শী। তারা কি দেখেছিল নাকি? তা হবে, আমার ঠিক মনে নেই; যদি দেখে থাকে সে সত্যি। তাঁর সেদিন ভারী অসুখ, আমার কোলে মাথা রেখেই তিনি শুয়েছিলেন।
নির্মল। (ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) তার পরে?
ষোড়শী। কোনমতে দিন কেটে যাচ্ছে, কিন্তু সেদিন থেকেই কিছুতে আর মন বসাতে পারিনে, সবই যেন মিথ্যে বলে ঠেকেছে।
নির্মল। কি মিথ্যে?
ষোড়শী। সব। ধর্ম, কর্ম, ব্রত, উপবাস, দেবসেবা, এতদিনের যা-কিছু সমস্তই—
নির্মল। তবে কিসের জন্যে ভৈরবীর আসন রাখতে চান?
ষোড়শী। এমনিই। আর আপনি যদি বলেন এতে কাজ নেই—
নির্মল। না না, আমি কিছুই বলিনে। কিন্তু এখন আমি উঠলাম। আপনার হয়ত কত কাজ নষ্ট করলাম।
ষোড়শী। কুটুম্বের অভ্যর্থনা, বন্ধুর মর্যাদা রক্ষা করা, এ কি কাজ নয় নির্মলবাবু?
নির্মল। সকাল হলো, এখন আসি?
ষোড়শী। আসুন। আমারও স্নানের সময় উত্তীর্ণ হয়ে যায়, আমিও চললাম।
[উভয়ের প্রস্থান
[সাগর সর্দার ও ফকিরসাহেবের প্রবেশ]
সাগর। না, এ চলবে না—কোনমতেই চলবে না ফকিরসাহেব। মা নাকি বলেচেন সমস্ত ত্যাগ করে যাবেন। আপনাকে বলচি এ চলবে না।
ফকির। কেন চলবে না সাগর?
সাগর। তা জানিনে। কিন্তু যাওয়া চলবে না। গেলে আমরা তাঁর দীন-দুঃখী প্রজারা সব থাকব কোথায়? বাঁচব কি করে?
ফকির। কিন্তু তোমরা কি শোননি ষোড়শী কত বড় লজ্জা এবং ঘৃণায় সমস্ত ত্যাগ করে যাচ্ছেন?
সাগর। শুনেচি। তাই আরও দশজনের মত আমরাও ভেবে পাইনি কিসের জন্য মা সাহেবের হাত থেকে সে রাত্রে জমিদারকে বাঁচাতে গেলেন। (ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) ভেবে নাই পেলাম ফকিরসাহেব, কিন্তু এটুকু ত ভেবে পেয়েছি, যাঁকে মা বলে ডেকেছি সন্তান হয়ে আমরা তাঁর বিচার করতে যাব না।
ফকির। তোমরা জন-কতক বিচার না করলেই কি চণ্ডীগড়ে তার বিচার করবার মানুষের অভাব হবে সাগর?
সাগর। কিন্তু তারাই কি মানুষ? আমরা তাঁর ছেলে—আমাদের অন্তরের বিশ্বাসের চেয়ে কি তাদের বাইরের বিচারটাই বড় হবে ফকিরসাহেব? তাদের কি আমরা চিনিনে? একদিন যখন আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নিলে তারা, সেও যেমন সত্যি-পাওনার দাবীতে, আবার জেলে যখন দিলে সেও তেমনি সত্যি-সাক্ষীর জোরে।
ফকির। সে আমি জানি।
সাগর। কিন্তু সব কথা ত জানো না। খুড়ো-ভাইপোয় জেল খেটে ফিরে এসে দাঁড়ালাম। বললাম, মা, আমরা যে মরি। মা রাগ করে বললেন, তোরা ডাকাত, তোদের মরাই ভালো। অভিমানে ঘরে ফিরে গেলাম। খুড়ো বললে, ভগবান! গরীবকে বিশ্বাস করতে কেউ নেই। পরের দিন সকালবেলা মা আমাদের ডেকে পাঠিয়ে বললেন, তোদের কাছে আমি মস্ত অপরাধ করেছি বাবা, আমাকে তোরা ক্ষমা কর্। তোদের কেউ বিশ্বাস না করুক আমি বিশ্বাস করব। এখনো বিঘে-কুড়ি জমি আমার আছে, তাই তোরা ভাগ করে নে। চণ্ডীর খাজনা তোরা যা ইচ্ছে দিস, কিন্তু অসৎ পথে কখনো পা দিবিনে, এই আমার শর্ত।
ফকির। কিন্তু লোকে যে বলে—
সাগর। বলুক। কিন্তু মা জানলেই হলো সে বিশ্বাস আমরা কখনো ভাঙ্গিনি। জানো ফকিরসাহেব, আমাদের জন্যেই এককড়ি তাঁর শত্রু, আমাদের জন্যেই রায়মশায় তাঁর দুশমন। অথচ, তারা জানেও না কার দয়ায় আজও তারা বেঁচে আছে।
ফকির। কিন্তু আমাকে তোরা ধরে আনলি কেন?
সাগর। কেন? শুনেছি, মুসলমান হয়েও তুমি তাঁর গুরুর চেয়ে বড়, তোমার নিষেধ ছাড়া মাকে কেউ আটকাতে পারবে না।
ফকির। কিন্তু এতবড় অন্যায় নিষেধ আমি কিসের জন্যে করব সাগর?
সাগর। করবে মানুষের ভালর জন্যে।
ফকির। কিন্তু ষোড়শী ঘরে নেই। বেলা যায়, আমিও ত আর অপেক্ষা করতে পারি নে। এখন আমি চললুম।
সাগর। পারবে না থাকতে? করবে না নিষেধ? কিন্তু ফল তার ভাল হবে না।
ফকির। এ-সব কথা মুখেও এনো না সাগর।
সাগর। মা-ও বলেন ও-কথা মুখে আনিস নে সাগর। বেশ মুখে আর আনব না—আমাদের মনের মধ্যেই থাক।