ষোড়শী। বেশ তাই হবে। যথার্থ অভিভাবক কে সে নিয়ে আমি বিবাদ করব না। আপনারা যদি মনে করেন আমি গেলে মন্দিরের ভালো হবে আমি যাব।
জীবানন্দ। তুমি যে যাবে সে ঠিক। কারণ, যাতে যাও সে আমি দেখব।
ষোড়শী। কেন রাগ করচেন, আমি ত সত্যিই যেতে চাচ্চি। কিন্তু আপনার ওপর এই ভার রইল যেন মন্দিরের যথার্থই ভাল হয়।
জীবানন্দ। কবে যাবে?
ষোড়শী। যখনই আদেশ করবেন। কাল, আজ, এখন—
জীবানন্দ। কিন্তু নির্মলবাবু? জামাইসাহেব?
ষোড়শী। (কাতর-কণ্ঠে) তাঁর নাম আর করবেন না।
জীবানন্দ। আমার মুখে তাঁর নামটা পর্যন্ত তোমার সহ্য হয় না। ভাল। কিন্তু কি তোমাকে দিতে হবে?
ষোড়শী। কিছুই না।
জীবানন্দ। এ ঘরখানা পর্যন্ত ছাড়তে হবে জানো? এও দেবীর।
ষোড়শী। জানি। যদি পারি, কালই ছেড়ে দেব।
জীবানন্দ। কোথায় যাবে ঠিক করেছ?
ষোড়শী। এখানে থাকব না, এর বেশি কিছুই ঠিক করিনি। একদিন কিছু না জেনেই আমি ভৈরবী হয়েছিলাম, আজ বিদায় নেওয়ার বেলাতেও এর বেশি ভাবব না। আপনি দেশের জমিদার, চণ্ডীগড়ের ভালোমন্দের ভার আপনার পরে রেখে যেতে শেষ সময়ে আর আমি দ্বিধা করব না। কিন্তু আমার বাবা ভারী দুর্বল, তাঁর উপরে নির্ভর করে যেন আপনি নিশ্চিন্ত হবেন না।
জীবানন্দ। তুমি কি সত্যিই চলে যেতে চাও নাকি?
ষোড়শী। আর আমার দুঃখী দরিদ্র ভূমিজ প্রজারা। একদিন তাদের সমস্তই ছিল—আজ তাদের মত নিঃস্ব নিরুপায় আর কেউ নেই। ডাকাত বলে বিনাদোষে লোকে তাদের জেল দিয়েছে। এদের সুখ-দুঃখের ভারও আমি আপনাকেই দিয়ে গেলাম।
জীবানন্দ। আচ্ছা, তা হবে হবে। কি তারা চায় বল ত?
ষোড়শী। সে তারাই আপনাকে জানাবে।
[এই বলিয়া সে সহসা জানালা দিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া দড়ির আলনা হইতে গামছা ও কাপড় হাতে লইল]
ষোড়শী। আমার স্নান করতে যাবার সময় হলো।
জীবানন্দ। স্নানের সময়? এই রাত্রে?
ষোড়শী। রাত আর নেই—এবার আপনি বাড়ি যান। (এই বলিয়া সে যাইতে উদ্যত হইল)
জীবানন্দ। (ব্যগ্রকণ্ঠে) কিন্তু আমার সকল কথাই যে বাকী রয়ে গেল?
ষোড়শী। থাক, আপনি বাড়ি যান।
জীবানন্দ। না। কোথায় যেন আমার মস্ত ভুল হয়ে গেছে অলকা, কথা আমার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি—
ষোড়শী। না সে হবে না, আপনি বাড়ি যান। আমার বহু ক্ষতিই করেছেন, এ জীবনের শেষ সর্বনাশ করতে আর আপনাকে দেব না।
জীবানন্দ। আচ্ছা, আমি চললাম অলকা।
[প্রস্থান]
ষোড়শী – ২.২
দ্বিতীয় দৃশ্য
চণ্ডীগড় গ্রাম—গাজনের সঙ
গীত (১)
বড় প্যাঁচে পড়েছে এবার ভোলা দিগম্বর।
অভিমানী উমারানী বলেনি তায় প্রাণেশ্বর।।
অনেকদিনের পরে এবার এল শ্বশুরবাড়ি।
ভেবেছিল আসবে গৌরী পরে পাটের শাড়ী।।
চাঁদ-বদনে কইবে কথা
ঘুচবে ভোলার প্রাণের ব্যথা
কোন কথা না বলে সে পালিয়ে এল ছেড়ে ঘর।
ভাবের ঘোরে ছিল অচেতন
ভেবে চিন্তে পেল নাকো হলো এ কেমন—
এবার শান্ত-শিষ্ট গৃহবাসী
করবে তোমায় হে সন্ন্যাসী
জটা বাকল ছাড়িয়ে নিয়ে সাজিয়ে দেবে প্রেমের বর।।
গীত (২)
বৌ নিতে এসেছে এবার আপনি মহেশ্বর।
তুই নাকি সই বলেছিলি
করবি না আর স্বামীর ঘর।।
পাঁচ বছরে করে পঞ্চতপা
তোর হাতে তোর মা-জননী সঁপেছেন ক্ষ্যাপা,
বাঁধতে যদি পারিস নি তায়,
তাই বলে কি হবে সে পর?
(তাই বলে পর হয়ে কি যায়)
একবার নাকি গিয়েছিল কুচুনী পাড়ায়
সত্যি কথা তোর কাছে সই যদিই সে ভাঁড়ায়।
ফেলার জিনিস নয় ত সে তোর বোন
ধুয়ে পুঁছে তুল গে যা তারে ঘর।।
ষোড়শী – ২.৩
তৃতীয় দৃশ্য
ষোড়শীর কুটীর
[নির্মলের প্রবেশ]
ষোড়শী। এ কি, এই রাত্রে শেষে অকস্মাৎ আপনি যে নিমর্লবাবু?
[নির্মল নিরুত্তর]
(হাসিয়া) ওঃ—বুঝেচি। যাবার পূর্বে লুকিয়ে বুঝি একবার দেখে যেতে এলেন?
নির্মল। আপনি কি অন্তর্যামী?
ষোড়শী। তা নইলে কি ভৈরবীগিরি করা যায় নির্মলবাবু? কিন্তু এখানটায় তেমন আলো নেই, আসুন, আমার ঘরের মধ্যে গিয়ে বসবেন চলুন।
নির্মল। রাত্রে একাকী আমাকে ঘরের মধ্যে নিয়ে যেতে চান, আপনার সাহস ত কম নয়?
ষোড়শী। আর সে-রাত্রে অন্ধকারে যখন হাত ধরে নদী পার করে এনেছিলাম তখনি কি ভয়ের লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলেন নাকি? সেদিনও ত এমনি একাকী।
নির্মল। সত্যই আপনার সাহসের অবধি নেই।
ষোড়শী। অবধি থাকবে কি করে নির্মলবাবু, ভৈরবী যে! আসুন ঘরে।
নির্মল। না, ঘরে আর যাব না, আমাকে এখনি ফিরতে হবে।
ষোড়শী। তবে এইখানেই বসুন।
[উভয়ের উপবেশন]
ষোড়শী। আজ তা হলে চলে যাওয়াই স্থির?
নির্মল। না, আজ যাওয়া স্থগিত রইল। রাত্রে ফিরে গিয়ে শুনতে পেলাম আজ সন্ধ্যাবেলায় মন্দিরের মধ্যে আপনার বিচার হবে। সে সভায় আমি উপস্থিত থাকতে চাই।
ষোড়শী। কিসের জন্যে? নিছক কৌতূহল, না আমাকে রক্ষে করতে চান?
নির্মল। প্রাণপণে চেষ্টা করব বটে।
ষোড়শী। যদি ক্ষতি হয়, কষ্ট হয়, শ্বশুরের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়, তবুও?
নির্মল। হাঁ, তবুও।
[ষোড়শী হাসিয়া ফেলিল]
(হাসিমুখে) আপনি হাসলেন যে বড়? বিশ্বাস হয় না?
ষোড়শী। হয়। কিন্তু হাসচি আর একটা কথা ভেবে। শুনি, আগেকার দিনে ভৈরবীরা নাকি বিদেশী মানুষদের ভেড়া বানিয়ে রাখত, আচ্ছা, ভেড়া নিয়ে তারা কি করত নির্মলবাবু? চরিয়ে বেড়াত, না লড়াই বাধিয়ে দিয়ে তামাশা দেখত? (বলিতে বলিতে ছেলেমানুষের মত উচ্ছ্বসিত হইয়া হাসিতে লাগিল)
নির্মল। (পরিহাসে যোগ দিয়া, নিজেও হাসিয়া) হয়ত বা মাঝে মাঝে মায়ের স্থানে বলি দিয়ে খেতো।