[প্রস্থান
[গৃহকোণে একখানা পত্রের খণ্ডাংশ পড়িয়া ছিল, জীবানন্দের দৃষ্টি পড়িতেই তাহা সে তুলিয়া লইয়া দীপালোকে পড়িয়া ফেলিল। তাহার মুহূর্তকাল পূর্বের সরস ও প্রফুল্ল মুখের চেহারা গম্ভীর ও অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিল। ষোড়শী খাবারের পাত্র লইয়া প্রবেশ করিল। তাহার মনে পড়িল ঠাঁই করা হয় নাই, তাই সে পাত্রটি তাড়াতাড়ি একধারে রাখিয়া আসনের অভাবে কম্বলই পুরু করিয়া পাতিল এবং নিজের একখানি বস্ত্র পাট করিয়া দিতেছিল, এমনি সময়ে জীবানন্দ কথা কহিলেন।]
জীবানন্দ। ও কি হচ্ছে?
ষোড়শী। আপনার ঠাঁই করচি। শুধু কম্বলটা ফুটবে।
জীবানন্দ। ফুটবে, কিন্তু আতিশয্যটা ঢের বেশী ফুটবে। যত্ন জিনিসটায় মিষ্টি আছে সত্যি, কিন্তু তার ভান করাটায় না আছে মধু, না আছে স্বাদ। ওটা বরঞ্চ আর কাউকে দিয়ো।
[কথা শুনিয়া ষোড়শী বিস্ময়ে অবাক হইয়া গেল]
জীবানন্দ। (হাতের কাগজ দেখাইয়া) ছেঁড়া চিঠি—সবটুকু নেই। যাঁকে লিখেছিলে তাঁর নামটি শুনতে পাইনে?
ষোড়শী। কার নাম?
জীবানন্দ। যিনি দৈত্য-বধের জন্য চণ্ডীগড়ে অবতীর্ণ হবেন, যিনি দ্রৌপদীর সখা—আর বলবো?
[এই ব্যঙ্গোক্তির ষোড়শী উত্তর দিতে পারিল না, কিন্তু তাহার চোখের উপর হইতে ক্ষণকাল পূর্বের মোহের যবনিকা খানখান হইয়া ছিঁড়িয়া গেল]
জীবানন্দ। এই আহ্বান-লিপির প্রতি ছত্রটি যাঁর কর্ণে অমৃত বর্ষণ করবে তাঁর নামটি?
ষোড়শী। (আপনাকে সংযত করিয়া লইয়া) তাঁর নামে আপনার প্রয়োজন?
জীবানন্দ। প্রয়োজন আছে বৈ কি। পূর্বাহ্নে জানতে পারলে হয়ত আত্মরক্ষার একটা উপায় করতে পারি।
ষোড়শী। আত্মরক্ষার প্রয়োজন ত একা আপনারই নয় চৌধুরীমশায়। আমারও ত থাকতে পারে।
জীবানন্দ। পারে বৈ কি!
ষোড়শী। তা হলে সে নাম আপনি শুনতে পাবেন না। কারণ, আমার ও আপনার একই সঙ্গে রক্ষা পাবার উপায় নেই।
জীবানন্দ। বেশ, তা যদি না থাকে রক্ষা পাওয়াটা আমারই দরকার এবং তাতে লেশমাত্র ত্রুটি হবে না জেনো। (ষোড়শী নিরুত্তর) তুমি জবাব না দিতে পারো, কিন্তু তোমার এই বীরপুরুষটির নাম যে আমি জানিনে তা নয়।
ষোড়শী। জানবেন বৈ কি। পৃথিবীর বীরপুরুষদের মধ্যে পরিচয় থাকবারই ত কথা।
জীবানন্দ। সে ঠিক। কিন্তু এই কাপুরুষকে বার বার অপমান করার ভারটা তোমার বীরপুরুষটি সইতে পারলে হয়। যাক, এ চিঠি ছিঁড়লে কেন?
ষোড়শী। এর জবাব আমি দেব না। জীবানন্দ। কিন্তু সোজা নির্মল সাহেবকে না লিখে তাঁর স্ত্রীকে লেখা কেন? এ শব্দভেদী বাণ কি তাঁরই শেখানো নাকি?
ষোড়শী। তার পরে?
জীবানন্দ। তার পরে আজ আমার সন্দেহ গেল। বন্ধুর সংবাদ আমি অপরের কাছে শুনেচি, কিন্তু রায়মশায়কে যতই প্রশ্ন করেচি, ততই তিনি চুপ করে গেলেন। আজ বোঝা গেল তাঁর আক্রোশটাই সবচেয়ে কেন বেশি।
ষোড়শী। (সচকিত) নির্মলের সম্বন্ধে আপনি কি শুনেছেন?
জীবানন্দ। সমস্তই। তোমার চমক আর গলার মিঠে আওয়াজে আমার হাসি পাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হাসতে পারলাম না—আমার আনন্দ করবার এ কথা নয়। সেই ঝড়-জল অন্ধকার রাত্রে একাকী তার হাত ধরে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া মনে পড়ে? তার সাক্ষী আছে। সাক্ষী ব্যাটারা যে কোথায় লুকিয়ে থাকে আগে থেকে কিছুই জানবার জো নেই। আমি যখন গাড়ি থেকে ব্যাগ নিয়ে পালাই, ভেবেছিলাম কেউ দেখেনি।
ষোড়শী। যদি সত্যই তাই করে থাকি সে কি এতবড় দোষের?
জীবানন্দ। কিন্তু গোপন করার চেষ্টাটা? এই চিঠির টুকরোটা? নিজেই একবার পড়ে দেখ ত কি মনে হয়? আমার মত ইনিও একবার তোমার বিচার করতে বসেছিলেন না?
দেখচি, তোমার বিচার করবার বিপদ আছে। (এই বলিয়া জীবানন্দ মুচকিয়া হাসিল। ষোড়শী নিরুত্তর) এ আমি সঙ্গে নিয়ে চললাম, আবশ্যক হলে যথাস্থানে পৌঁছে দেবার ত্রুটি হবে না। এই ক’টা ছত্র আমার পুরুষের চোখকেই যখন ফাঁকি দিতে পারেনি, তখন আশা করি হৈমকেও ঠকাতে পারবে না।
[ষোড়শী নিরুত্তর]
জীবানন্দ। কেমন, অনেক কথাই জানি?
ষোড়শী। হাঁ।
জীবানন্দ। এ-সব তবে সত্যি বল?
ষোড়শী। হাঁ, সত্যি।
জীবানন্দ। (আহত হইয়া) ওঃ—সত্যি! (স্তিমিত দীপশিখাটা উজ্জ্বল করিয়া দিয়া ষোড়শীর মুখের প্রতি তীক্ষ্ণচক্ষে চাহিয়া) এখন তাহলে তুমি কি করবে মনে কর?
ষোড়শী। কি আমাকে আপনি করতে বলেন?
জীবানন্দ। তোমাকে? (ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া, দীপশিখা পুনরায় উজ্জ্বল করিয়া দিয়া) তা হলে এঁরা সকলে যে তোমাকে অসতী বলে—
ষোড়শী। এঁদের বিরুদ্ধে আপনার কাছে ত আমি নালিশ জানাই নি। আমাকে কি করতে হবে তাই বলুন। কারণ দেখাবার প্রয়োজন নেই।
জীবানন্দ। তা বটে। কিন্তু সবাই মিথ্যা কথা বলে, আর তুমি একাই সত্যবাদী এই কি আমাকে তুমি বোঝাতে চাও অলকা?
[ষোড়শী নিরুত্তর]
জীবানন্দ। একটা উত্তর দিতেও চাও না?
ষোড়শী। (মাথা নাড়িয়া) না।
জীবানন্দ। অর্থাৎ আমার কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার চেয়ে দুর্নামও ভালো। বেশ, সমস্তই স্পষ্ট বোঝা গেছে! (এই বলিয়া তিনি ব্যঙ্গ করিয়া হাসিলেন)
ষোড়শী। স্পষ্ট বোঝা যাবার পরে কি করতে হবে তাই শুধু বলুন!
[তাহার এই উত্তরে জীবানন্দের ক্রোধ ও অধৈর্য শতগুণে বাড়িয়া গেল]
জীবানন্দ। কি করতে হবে সে তুমি জানো, কিন্তু আমাকে দেবমন্দিরের পবিত্রতা বাঁচাতেই হবে। এর যথার্থ অভিভাবক তুমি নয়, আমি। পূর্বে কি হতো জানিনে, কিন্তু এখন থেকে ভৈরবীকে ভৈরবীর মতই থাকতে হবে, না হয় তাকে যেতে হবে।